সড়কে সৃষ্ট বড় গর্তে জমে আছে পানি। গাড়ি চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন চালকেরা। বৃহস্পতিবার বিকেল চারটায় চট্টগ্রাম নগরের সদরঘাট এলাকায়
সড়কে সৃষ্ট বড় গর্তে জমে আছে পানি। গাড়ি চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন চালকেরা। বৃহস্পতিবার বিকেল চারটায় চট্টগ্রাম নগরের সদরঘাট এলাকায়

চট্টগ্রাম নগর

এক বর্ষায় ভেঙেছে ৩৮৮ সড়ক, মেরামতে লাগবে ৪২০ কোটি টাকা

চলতি বর্ষা মৌসুমে ৩৮৮টি সড়ক ভেঙেছে। বিধ্বস্ত রাস্তার পরিমাণ ১৪২ কিলোমিটার। পাঁচ বছরের মধ্যে এবারই সড়ক সর্বোচ্চ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভেঙে যাওয়া রাস্তা ঠিক করতে করপোরেশনের লাগবে ৪২০ কোটি টাকা।

চট্টগ্রাম নগরের ব্যস্ততম মোড়গুলোর একটি ২ নম্বর গেট। সেখানে ছোট-বড় অনেক গর্ত। এ রকম একটি গর্তে পড়ে প্রায় উল্টে যাওয়ার অবস্থা হয়েছিল রিকশাচালক মোহাম্মদ হোসেনের। কোনোরকমে সামলে নেন তিনি। এরপর ক্ষোভ প্রকাশ করে মোহাম্মদ হোসেন বলেন, রাস্তায় খালি গর্ত আর গর্ত। গর্তের যন্ত্রণায় গাড়ি চালাতে পারেন না। ইট দিয়ে কোনোরকমে ভরাট করলেও তা টেকে না। বৃষ্টি হলেই গাড়ির চাপে আবার ভাঙে। বছরের পর বছর ধরে এটাই দেখে আসছেন। গত বুধবার বেলা সাড়ে তিনটায় কথা হয় রিকশাচালক মোহাম্মদ হোসেনের সঙ্গে।

শুধু এবার নয়, বর্ষার সময় বৃষ্টি হলেই চট্টগ্রাম নগরের প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে অলিগলি সব ভাঙে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ভাঙা রাস্তার তালিকা করে। এবারও তালিকা করেছে। চলতি বর্ষা মৌসুমে ৩৮৮টি সড়ক ভেঙেছে। বিধ্বস্ত রাস্তার পরিমাণ ১৪২ কিলোমিটার। পাঁচ বছরের মধ্যে এবারই সড়ক সর্বোচ্চ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভেঙে যাওয়া রাস্তা ঠিক করতে করপোরেশনের লাগবে ৪২০ কোটি টাকা।

ভাঙা সড়কে গাড়ি চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ কারণে যানজটের সমস্যায় ভুগছেন চালক ও যাত্রীরা। আবার ভাঙা রাস্তার কারণে গাড়ির যন্ত্রাংশ নষ্ট হচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে বারবার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার জন্য দুটি কারণকে দায়ী করছেন সিটি করপোরেশনের প্রকৌশলীরা। তাঁদের মতে, ভারী বর্ষণ হলে সড়কে পানি জমে যায়। তখন বিটুমিনের রাস্তায় খানাখন্দ সৃষ্টি হয়। আর নগরের রাস্তাঘাটগুলো করা হয় ১০ থেকে ২০ টন ওজনের বহনক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে। কিন্তু বন্দর থাকায় এখানে ৫০ থেকে ৬০ টনের গাড়িও চলে। ভারী ওজনের গাড়ি চলাচলের কারণে রাস্তা নষ্ট হয়। তবে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের দুটি কারণের পাশাপাশি সড়ক সংস্কারকাজের গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা।

৫ বছরের মধ্যে বেশি ক্ষতি

পাঁচ বছরের মধ্যে এবার সবচেয়ে বেশি রাস্তাঘাট ভেঙে বেহাল হয়েছে। ৩৮৮টি সড়কের ১৪২ কিলোমিটার অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত বছর ভেঙেছিল ১০০ কিলোমিটার। ২০২৩ সালে ৫০ কিলোমিটার, ২০২২ সালে ১০০ কিলোমিটার ও ২০২১ সালে ৩৬ কিলোমিটার সড়ক নষ্ট হয়েছিল।

পয়োনিষ্কাশন প্রকল্পের জন্য খোঁড়াখুঁড়ি করায় নগরের আগ্রাবাদে সিডিএ আবাসিক এলাকার প্রায় সব সড়ক এখন ভাঙাচোরা। নগরের দক্ষিণ আগ্রাবাদ ওয়ার্ডে এ এলাকার অবস্থান। নগরের সবচেয়ে বেশি ৫৫টি সড়ক ভেঙেছে এই ওয়ার্ডে।

গত বুধবার দুপুরে সরেজমিন দেখা যায়, নগরের বায়েজিদ বোস্তামী সড়কের ২ নম্বর গেট থেকে অক্সিজেনমুখী অংশে খানাখন্দ ভরাট ও পিচঢালাই (কার্পেটিং) করার কাজ চলছে। তবে অক্সিজেন থেকে ২ নম্বর গেটমুখী অংশে রয়েছে গর্ত। বিশেষ করে উড়ালসড়কের র‍্যাম্পের নিচে বেবি সুপারমার্কেট এলাকার অবস্থা বেশি নাজুক।

নগরের সিডিএ অ্যাভিনিউ সড়কের ২ নম্বর গেট মোড়ের আশপাশেও পিচঢালাই উঠে গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। সিআরবির সড়কগুলোরও একই অবস্থা। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থা দেখা গেছে স্ট্র্যান্ড রোডের। সেখানে বড় বড় গর্তে জমে আছে পানি, যা দিয়ে গাড়ি চলাচল অসম্ভব হয়ে পড়েছে। আবদুল হালিম নামের এক সিএনজি অটোরিকশাচালক সড়কের অবস্থা দেখে বলেন, এটা সড়ক নয়, যেন পুকুর। এত বড় গর্তে পড়লে গাড়ি তো এমনিতেই উল্টে যাবে। তখন চালক বা যাত্রীর কেউ বাঁচবেন না।

ক্ষতবিক্ষত আগ্রাবাদ এলাকার সড়ক। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায়

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র শাহাদাত হোসেনের বাসা নগরের বাদশা মিয়া সড়কে। এই সড়কেও গর্ত রয়েছে। ইট দিয়ে ভরাট করে দিলেও তা কিছুদিন পরপর ভেঙে যায়। পয়োনিষ্কাশন প্রকল্পের জন্য খোঁড়াখুঁড়ি করায় নগরের আগ্রাবাদে সিডিএ আবাসিক এলাকার প্রায় সব সড়ক এখন ভাঙাচোরা। নগরের দক্ষিণ আগ্রাবাদ ওয়ার্ডে এই এলাকার অবস্থান। নগরের সবচেয়ে বেশি ৫৫টি সড়ক ভেঙেছে এই ওয়ার্ডে।

বিটুমিনের বড় শত্রু হচ্ছে পানি। বৃষ্টির সময় সড়কে পানি জমে থাকার কারণে বিটুমিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গাড়ির চাপে রাস্তা ভেঙে যায়। আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে, নগরের সড়কগুলো ১০ থেকে ২০ টনের ওজনের গাড়ির ভর নিতে পারে। কিন্তু বন্দরের পণ্যবাহী ৫০ থেকে ৬০ টনের গাড়ি চলাচল করে। বেশি ওজনের গাড়ি চলাচলের কারণে সংস্কারের পরও রাস্তা নষ্ট হচ্ছে।
—আনিসুর রহমান, প্রধান প্রকৌশলী, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন

সিটি করপোরেশনের তালিকা অনুযায়ী, দক্ষিণ আগ্রাবাদের পর সবচেয়ে বেশি রাস্তা খারাপ হয়েছে শুলকবহর ওয়ার্ডে। এই ওয়ার্ডে ৩১টি রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নগরের চান্দগাঁও ওয়ার্ডে ২১টি, উত্তর আগ্রাবাদে ২০, পাঁচলাইশ ওয়ার্ডে ১৮, উত্তর কাট্টলীতে ১৯, পশ্চিম ষোলশহরে ১৪, লালখান বাজারে ১৩টি করে রাস্তা এবারের বৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দক্ষিণ হালিশহরে ১৩টি, দক্ষিণ মধ্যম হালিশহরে ১২ ও উত্তর পতেঙ্গায় ১০টি সড়ক ভেঙেছে।

প্রতিবার বর্ষায় সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণ জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী আনিসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম নগরের সড়কগুলো বিটুমিনের তৈরি। বিটুমিনের বড় শত্রু হচ্ছে পানি। বৃষ্টির সময় সড়কে পানি জমে থাকার কারণে বিটুমিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গাড়ির চাপে রাস্তা ভেঙে যায়। আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে, নগরের সড়কগুলো ১০ থেকে ২০ টনের ওজনের গাড়ির ভর নিতে পারে। কিন্তু বন্দরের পণ্যবাহী ৫০ থেকে ৬০ টনের গাড়ি চলাচল করে। বেশি ওজনের গাড়ি চলাচলের কারণে সংস্কারের পরও রাস্তা নষ্ট হচ্ছে।’ তবে তিনি সংস্কারের গুণগত মান ও নিম্নমানের উপকরণের বিষয়টি স্বীকার করেননি।

এদিকে সিটি করপোরেশনের নিজস্ব তহবিল ও প্রকল্পের মাধ্যমে নগরের রাস্তাঘাটগুলো সংস্কার করে। বর্তমানে ৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ব্যয়ে দুটি বড় প্রকল্পের কাজ চলমান। এর আগেও একাধিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে।

সিটি করপোরেশনের সংস্কারের পরও কেন রাস্তা টিকছে না, তা জানতে চাইলে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক স্বপন কুমার পালিত বলেন, ‘একটি সড়ক পরিকল্পিতভাবে করা হলে অন্তত ১০ থেকে ১৫ বছর টিকে থাকার কথা। চট্টগ্রাম নগরের ড্রেনেজব্যবস্থা ভালো নয়, যার কারণে সড়কগুলো অনেক সময় পানিতে ডুবে থাকে। এ কারণে সড়ক নষ্ট হয়। তবে নির্মাণকাজে মানসম্পন্ন উপকরণ ব্যবহার না করা, ঠিকাদারদের তদারক না করার কারণে কাজগুলো হয় যাচ্ছেতাই। ফলে অল্প দিনেই সড়কগুলো বেহাল হয়ে পড়ে।’