কমিউনিটি ক্লিনিক এখন অযত্ন, অবহেলার শিকার। কোনো কোনোটির ছাদ ও দেয়াল খসে পড়ছে। কোনোটিতে যাওয়া-আসার রাস্তা নেই। আবার কোনোটিতে জোয়ারের পানি ঢোকে। বাস্তবতা হলো, কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে মানুষ ঠিকমতো সেবা পাচ্ছে না।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেশের কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর এ চিত্র ধরা পড়েছে। সাংবাদিকেরা দেখেছেন, অধিকাংশ কমিউনিটি ক্লিনিকের গ্লুকোমিটার কাজ করে না। কিছু কমিউনিটি ক্লিনিকে স্বাস্থ্যকর্মী নেই। অন্তত একটি এলাকার মানুষ অভিযোগ করেছেন, কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে টাকা দিয়ে ওষুধ কিনতে হয়।
প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা গত আগস্ট মাসের শেষ দুই সপ্তাহে দেশের আট বিভাগের আট জেলার ৩২টি ক্লিনিক সরেজমিন দেখেছেন, অনেক ক্লিনিকে যাওয়ার রাস্তা নেই, বর্ষাকালে পানিতে কিছু ডুবে থাকে, কিছু ক্লিনিক ভাঙাচোরা, কয়েকটি ক্লিনিকের টয়লেট খারাপ, প্রায় সব ক্লিনিকের গ্লুকোমিটার যন্ত্র অলস পড়ে আছে। ক্লিনিকগুলোয় জনবলের সংকট আছে, আছে ওষুধ বিক্রির অভিযোগ। বস্তুত কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে গ্রামের মানুষ কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছে না।
এই আট জেলা হচ্ছে পঞ্চগড়, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, মানিকগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নোয়াখালী, সুনামগঞ্জ ও নওগাঁ। এ ছাড়া খুলনাসহ আরও কিছু জেলায় কমিউনিটি ক্লিনিকের অবস্থা জানা গেছে মুঠোফোনে কথা বলে।
প্রথম আলোর সাংবাদিকেরা ক্লিনিকে সেবা নিতে আসা মানুষের মতামত নিয়েছেন, কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারের (সিএইচসিপি) সঙ্গে কথা বলেছেন, কিছু ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট জেলার সিভিল সার্জনের বক্তব্য নিয়েছেন। প্রায় সব ক্ষেত্রেই অসন্তুষ্টি দেখা গেছে।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেশের কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর এ চিত্র ধরা পড়েছে। সাংবাদিকেরা দেখেছেন, অধিকাংশ কমিউনিটি ক্লিনিকের গ্লুকোমিটার কাজ করে না। কিছু কমিউনিটি ক্লিনিকে স্বাস্থ্যকর্মী নেই। অন্তত একটি এলাকার মানুষ অভিযোগ করেছেন, কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে টাকা দিয়ে ওষুধ কিনতে হয়।
কমিউনিটি ক্লিনিক পরিচালনার মূল দায়িত্ব সিএইচসিপির। তাঁরা সরকারের রাজস্ব খাতের ১৬তম গ্রেডের কর্মী। সিএইচসিপিকে সহায়তা করেন স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবারকল্যাণ সহকারী। তাঁরাও রাজস্ব খাতের একই গ্রেডের কর্মী। তবে কমিউনিটি ক্লিনিকে কোনো আয়ার পদ নেই। বিদ্যুৎ বিল সরকার দেয় না। কমিউনিটি ক্লিনিক পরিচালনার জন্য ১১ সদস্যের কমিউনিটি গ্রুপ থাকে। ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য, জমিদাতা, সিএইচসিপি এই গ্রুপের সদস্য। গ্রুপটি স্থানীয়ভাবে তহবিল গঠন করে আয়ার বেতন ও বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করে।
মানুষের দোরগোড়ায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৮ সালে কমিউনিটি ক্লিনিক গড়ে তোলার কাজ শুরু করে। ২০০১ সালের পর কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়। পরে ২০০৯ সালে আবার চালু হয়। সারা দেশে কমিউনিটি ক্লিনিকের সংখ্যা ১৪ হাজার ৪৬০।
এসব ক্লিনিক থেকে ২২ ধরনের ওষুধ বিনা মূল্যে দেওয়ার কথা। পরিকল্পনা অনুযায়ী, দৈনিক গড়ে পাঁচ লাখ মানুষের এসব ক্লিনিক থেকে সেবা পাওয়ার কথা। স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদনে কমিউনিটি ক্লিনিকের নাম পাল্টে ‘গ্রামীণ স্বাস্থ্য কেন্দ্র’ করার সুপারিশ করেছে।
প্রথম আলোর পর্যবেক্ষণের বিষয়ে কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আখতারুজ্জামান আগস্টে বলেছিলেন, প্রায় ১০ শতাংশ কমিউনিটি ক্লিনিক ভবনের অবস্থা খারাপ, এগুলোর সংস্কার দরকার। সেপ্টেম্বর মাস থেকে প্রতিটি ক্লিনিকে ওষুধ নিয়মিতভাবে পাঠানো হচ্ছে।
প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা গত আগস্ট মাসের শেষ দুই সপ্তাহে দেশের আট বিভাগের আট জেলার ৩২টি ক্লিনিক সরেজমিন দেখেছেন, অনেক ক্লিনিকে যাওয়ার রাস্তা নেই, বর্ষাকালে পানিতে কিছু ডুবে থাকে, কিছু ক্লিনিক ভাঙাচোরা, কয়েকটি ক্লিনিকের টয়লেট খারাপ, প্রায় সব ক্লিনিকের গ্লুকোমিটার যন্ত্র অলস পড়ে আছে। ক্লিনিকগুলোতে জনবলের সংকট আছে, আছে ওষুধ বিক্রির অভিযোগ।
তবে গতকাল শুক্রবার খুলনার দাকোপ উপজেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত মে মাসের পর ওই উপজেলার ২৪টি কমিউনিটি ক্লিনিকে ওষুধ পৌঁছায়নি। একটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর কাছে প্যারাসিটামল ছাড়া আর কিছু নেই। গ্রামের মানুষ এলে শুধু প্যারাসিটামল দিচ্ছেন, স্বাস্থ্যশিক্ষা দিচ্ছেন আর দুঃখ প্রকাশ করছেন।
ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার মগর ইউনিয়নের কারুয়াকাঠী গ্রামের ক্লিনিকটির নাম কারুয়াকাঠী কমিউনিটি ক্লিনিক। গ্রামের গৃহিণী মনোয়ারা বেগম বলেন, এখানে জ্বর-সর্দি ও জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ি ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না। যে কয় ধরনের ওষুধ আসে, তা খুবই কম। এখানে মাসের ১৫ দিনের মধ্যে ওষুধ ফুরিয়ে যায়।
জরাজীর্ণ ক্লিনিকটি দেখিয়ে একই গ্রামের কৃষক ওসমান সিকদার বলেন, এখানে চিকিৎসার কোনো পরিবেশ নেই। ক্লিনিকটির সংস্কার দরকার।
২০১২ সালে তৈরি করা ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার কারুয়াকাঠী কমিউনিটি ক্লিনিকটি একটি খালের কাছে। গত ২৫ আগস্ট ওই ক্লিনিকে গিয়ে দেখা যায়, নিচু জমিতে ক্লিনিকটি তৈরি করা হয়েছে। পানি ওঠানামার কারণে ক্লিনিকের সামনে নালার মতো তৈরি হয়েছে। ক্লিনিক ভবনের চারপাশে ও ভেতরের দেয়ালে পানির দাগ।
গ্রামের গৃহিণী মনোয়ারা বেগম বলেন, এখানে জ্বর-সর্দি ও জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ি ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না। যে কয় ধরনের ওষুধ আসে, তা খুবই কম। এখানে মাসের ১৫ দিনের মধ্যে ওষুধ ফুরিয়ে যায়।
সেবা নিতে আসা মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খালটি দুই কিলোমিটার দূরের সুগন্ধা নদীর সঙ্গে যুক্ত। অমাবস্যা ও পূর্ণিমায় সুগন্ধা নদীতে ভরা জোয়ারের পানিতে ডুবে যায় এই ক্লিনিক। প্রতি মাসে অন্তত দুবার পানির নিচে চলে যায় ক্লিনিকটি। তখন ক্লিনিকে কেউ আসেন না। বহু বছর ধরে এমনটি চলছে।
ক্লিনিকে বর্ষার পানি ঢোকার কারণে ভেতরে বসতে পারি না। সাপ আসে।সিএইচসিপি শাহীনা বেগম
এর আগে ১৯ আগস্ট ময়মনসিংহ জেলার ঈশ্বরগঞ্জ-উচাখালীর সড়কের পাশে পাইকুড়া গ্রামের বড়হিত কমিউনিটি ক্লিনিকে গিয়ে দেখা যায়, পরিস্থিতি আরও খারাপ। ক্লিনিকটির অনেকটাই পানিতে ডুবে আছে, পলেস্তারা খসে পড়ছে। প্রথম দৃষ্টিতে মনে হয়, ক্লিনিকটি একটি ডোবার মধ্যে। এলাকার মানুষ জানিয়েছেন, পুরো বর্ষা মৌসুমে ক্লিনিকের বাইরে ও ভেতরে পানি জমে থাকে। এ সময় ক্লিনিকে কোনো সেবা দেওয়া হয় না। স্থানীয় বাসিন্দা আমেনা খাতুন বলেন, ভেতরে হাঁটুপানি হয়ে যায়। ক্লিনিক খোলা সম্ভব হয় না। সিএইচসিপি, পরিবার পরিকল্পনা সহকারী ও স্বাস্থ্য সহকারী তখন আসেন না।
একই দিনে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার আলালপুর কমিউনিটি ক্লিনিকে গিয়ে আরও দুর্দশা চোখে পড়ে। ক্লিনিকটি ঝোপঝাড়ে ঘেরা, পানিতে নিমজ্জিত। ভেতরের কক্ষগুলোতেও পানি। এই ক্লিনিকে সিএইচসিপির দায়িত্বে আছেন শাহীনা বেগম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ক্লিনিকে বর্ষার পানি ঢোকার কারণে ভেতরে বসতে পারি না। সাপ আসে।’
প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা বেশ কয়েকটি ক্লিনিক পেয়েছেন, যেগুলোতে যাওয়ার কোনো রাস্তা নেই অথবা সংস্কার না করার কারণে রাস্তাগুলো বেহাল। এটি অনেকটা সাধারণ চিত্র।
কিন্তু ময়মনসিংহ জেলার মধ্যনগর উপজেলার কায়েতকান্দা কমিউনিটি ক্লিনিকটির অবস্থা একটু বেশি খারাপ। ক্লিনিকটির চারদিকে পানি। যাওয়ার কোনো রাস্তাই নেই। ২০১২ সালে ক্লিনিকটি তৈরির পর প্রতি বর্ষাকালেই পানির নিচে ডুবে থাকে। তবে বর্ষায় ক্লিনিকটির কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ থাকে বলা যাবে না। স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, কায়েতকান্দা গ্রামের সুধাংশু তালুকদারের বাড়ির একটি পরিত্যক্ত টিনশেডে ক্লিনিকের কাজ চলে।
১৯ আগস্ট সুধাংশু তালুকদারের বাড়িতে পাওয়া যায় সিএইচসিপি জ্যোতির্ময় তালুকদারকে। তিনি একটি টেবিলের কাছে বসে ছিলেন। টেবিলের ওপর কিছু ওষুধ রাখা ছিল।
ওই গ্রামের অনিতা সরকার বলেন, ‘বাইস্যা মাসেও এই ক্লিনিকটা তালামারা থাকে। শুকনা মাসে খোলা থাকে। তখন ক্লিনিকের কাজকাম চলে কায়েতকান্দা গ্রামের একটি ঘরে।’
২২ আগস্ট নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর উপজেলার হাজীনগর উপজেলার কন্যাপাড়া কমিউনিটি ক্লিনিকে গিয়ে দেখা যায়, ক্লিনিক ভবনের দেয়াল, পিলার ও ছাদে ফাটল। কোনো কোনো স্থান থেকে লোহার শিক বেরিয়ে আছে। ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। তারপরও সেখানে ক্লিনিক চলে, মানুষ সেবা নিতে আসে।
কন্যাপাড়া কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি ইমরান হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় এ ভবনেই ঝুঁকি নিয়ে সেবা দিচ্ছি। এখানে যতক্ষণ থাকি, আতঙ্কে থাকি। মাঝেমধ্যে ছাদের পলেস্তারা খসে পড়ে।’
এমন বেহাল ক্লিনিক আরও আছে। দুই বছর আগে একই উপজেলার পাড়ইল ইউনিয়নের ফুলহারা কমিউনিটি ক্লিনিক ভবন পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। ক্লিনিকের কাজ হয় ফুলহারা বড়সমাসপুর নুরানী হাফেজিয়া মাদ্রাসার একটি কক্ষে।
ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় এ ভবনেই ঝুঁকি নিয়ে সেবা দিচ্ছি। এখানে যতক্ষণ থাকি, আতঙ্কে থাকি। মাঝেমধ্যে ছাদের পলেস্তারা খসে পড়ে।কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি ইমরান হোসেন
ক্লিনিকটির সিএইচসিপি নুরুজ্জামান বুলবুল প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে ক্লিনিক ভবন নির্মাণ করা হয়। দীর্ঘদিন সংস্কারের অভাবে দেয়াল ও ছাদের পলেস্তারা খসে খসে পড়ত। ধীরে ধীরে দেয়াল ও ছাদে ফাটল ধরে। দুই বছর আগে ভবনটি একেবারেই ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এখন মাদ্রাসার একটি কক্ষে ক্লিনিক চলছে।
এ ছাড়া নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার চান্দাশ কমিউনিটি ক্লিনিকের ছাদে পলিথিন ব্যবহার করা হয়েছে বৃষ্টির পানি ঠেকানোর জন্য। তারপরও ছাদ থেকে পানি চুইয়ে দেয়াল বেয়ে মেঝেতে জমা হতে দেখা গেছে। ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার কারুয়াকাঠী কমিউনিটি ক্লিনিকের ছাদ ও দেয়াল থেকে পলেস্তারা খসে পড়ার দৃশ্য চোখে পড়েছে।
একই অবস্থা বাগেরহাট জেলার চরকাঠি কমিউনিটি ক্লিনিক ও বারুইপাড়া কমিউনিটি ক্লিনিকের; মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওর উপজেলার হিজুলিয়া কমিউনিটি ক্লিনিক ও সাটুরিয়া উপজেলার ঘিওর কমিউনিটি ক্লিনিকের।
নওগাঁর সিভিল সার্জন আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছয় মাস হলো আমি সিভিল সার্জনের দায়িত্ব নিয়েছি। এই সময়ে জেলার যে কয়েকটি কমিউনিটি ক্লিনিক পরিদর্শন করেছি, তাতে খুবই হতাশাজনক চিত্র চোখে পড়েছে। জেলার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কমিউনিটি ক্লিনিক ভবন জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। এগুলো সংস্কার করেও কাজ চালানো সম্ভব নয়।’
গ্রামীণ মানুষের সেবার জন্য স্থাপিত কমিউনিটি ক্লিনিক দখল করে রাখার এক খারাপ নজির তৈরি করেছেন ঝালকাঠি সদরের বাসন্ডা ইউনিয়ন পরিষদের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মনির হোসেন। তিনি আগরবাড়ি কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি।
এলাকার মানুষের অভিযোগ, মনির হোসেন তাঁর ইচ্ছেমতো ক্লিনিক চালাতেন। অধিকাংশ সময় ক্লিনিক বন্ধ রাখতেন। শুধু টিকাদান কর্মসূচির সময় ক্লিনিক খোলা হতো। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর মনির হোসেন এলাকা ছেড়ে পালিয়েছেন।
এরপর সেখানে মনিরা খানম নামের একজন সিএইচসিপিকে স্বাস্থ্য বিভাগ দায়িত্ব দেয়। কিন্তু তিনিও ক্লিনিকটি সব সময় খোলেন না বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। এ বিষয়ে মনিরা খানম বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ক্লিনিকটি খোলা রাখার চেষ্টা করি। মাঝখানে ছয় মাস ওষুধ সরবরাহ বন্ধ ছিল। এখন রোগীরা নিয়মিত চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন।’
কমিউনিটি ক্লিনিকে ওষুধের জন্য গেলে ট্যায়া (টাকা) দিতে অয়। না অয় ওষুধ দেয় না। হিয়াল্লাই (সে কারণে) আমরা অন (এখন) অসুখ অইলে দোকানেত্তুন ওষুধ কিনি আনি।মাছিমপুর গ্রামের গৃহিণী রোজিনা বেগম
কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে ২২ ধরনের ওষুধ মানুষকে বিনা মূল্যে দেওয়া হয়। একসময় অ্যান্টিবায়োটিকসহ ৩২ ধরনের ওষুধ দেওয়া হতো। একপর্যায়ে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া বন্ধ হয়। কোথাও কোথাও টাকা নিয়ে ওষুধ দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বাগেরহাটের চরকাঠি কমিউনিটি ক্লিনিকে ওষুধ বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। যাঁরা ওষুধ নেন, প্রত্যেককে দুই টাকা দিতে হয়। চরকাঠি গ্রামের কুলসুম বেগম ওই ক্লিনিকে আয়ার কাজ করেন। তিনি জানান, তাঁর বেতন ও বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করা হয় ওষুধ বিক্রির টাকায়।
নোয়াখালী সদর উপজেলার অশ্বদিয়া ইউনিয়নের মাছিমপুর কমিউনিটি ক্লিনিকে ওষুধ বিক্রির অভিযোগ পাওয়া গেছে। মাছিমপুর গ্রামের গৃহিণী রোজিনা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘কমিউনিটি ক্লিনিকে ওষুধের জন্য গেলে ট্যায়া (টাকা) দিতে অয়। না অয় ওষুধ দেয় না। হিয়াল্লাই (সে কারণে) আমরা অন (এখন) অসুখ অইলে দোকানেত্তুন ওষুধ কিনি আনি।’
একদিনের ঘটনার কথা উল্লেখ করে রোজিনা বলেন, কিছুদিন আগে তাঁর মেয়ে হয়েছিল। তিনি স্যালাইনের জন্য ক্লিনিকে গেলে বলা হয়, টাকা ছাড়া স্যালাইন দেওয়া হবে না। সঙ্গে টাকা না থাকায় তিনি স্যালাইন নিতে পারেননি। পরে দোকান থেকে স্যালাইন কেনেন।
সুনামগঞ্জ জেলার মান্নারগাঁও কমিউনিটি ক্লিনিকের সিইএচসিপির টেবিলের পাশে একটি বাক্স প্রথম আলোর প্রতিনিধির চোখে পড়ে। সেবা নিতে আসা মানুষ তাতে পাঁচ টাকা করে জমা দেন। এই টাকা দিয়ে ভবন সংস্কার ও ক্লিনিকের আনুষঙ্গিক কাজ করা হয় বলে জানা গেছে।
জেলার অধিকাংশ এলাকার কমিউনিটি ক্লিনিকে সেবা নিতে আসা লোকজন বলেছেন, ক্লিনিকগুলো চাহিদামতো ওষুধ দিতে পারে না। সুনামগঞ্জের মান্নারগাঁও কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি জহিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওষুধ তিনটা দরকার হলে একটা দিয়া বুঝ দেই। কিন্তু মানুষ তো বুঝতে চায় না।’
কমিউনিটি ক্লিনিকে সেবা দেওয়ার মূল দায়িত্বে থাকেন কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার বা সিএইচসিপি। সারা দেশে ৫০৯টি কমিউনিটি ক্লিনিকে কোনো সিএইচসিপি নেই।
সিএইচসিপি না থাকায় ১০ মাস ধরে ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইল উপজেলার সৈয়দগাঁও কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবা বন্ধ।
প্রতিটি ক্লিনিক থেকে গ্রামের মানুষকে সেবা দেওয়ার দায়িত্বে থাকেন সিএইচসিপি, স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবারকল্যাণ সহকারী। সকাল ৯টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত ক্লিনিক খোলা থাকে। সিএইচসিপি শুক্রবার ও সরকারি ছুটির দিন ছাড়া সপ্তাহে ছয় দিন ক্লিনিকে উপস্থিত থাকবেন। স্বাস্থ্য সহকারী সপ্তাহে তিন দিন ও পরিবারকল্যাণ সহকারী বাকি তিন দিন ক্লিনিকে উপস্থিত থেকে সিএইচসিপিকে সহায়তা দেন।
১৯ আগস্ট সরেজমিন সৈয়দগাঁও কমিউনিটি ক্লিনিক তালাবদ্ধ দেখা যায়। ক্লিনিকের সিঁড়িতে লাকড়ি শুকাতে দেওয়া হয়েছে। এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ১০ মাস ধরে সিএইচসিপির পদে কেউ না থাকায় ক্লিনিক বন্ধ আছে। গ্রামের মানুষ সেবা বা ওষুধ কিছুই পাচ্ছেন না। সাধারণ সমস্যা সমাধানের জন্য গ্রামের মানুষকে যেতে হচ্ছে উপজেলায়। নতুন সিএইচসিপি নিয়োগ না দেওয়ায় মানুষ ক্ষুব্ধ।
সুনামগঞ্জের কায়েতকান্দা কমিউনিটি ক্লিনিকের আশপাশের বাসিন্দারা অভিযোগ করেছেন, সিএইচসিপি ছাড়া বাকি দুজন ক্লিনিকে আসেন অনিয়মিতভাবে। এ জেলার মান্নারগাঁও কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি মাহফুজ আলম খান বলেছেন, তাঁর অন্য দুই সহকর্মী ঠিকমতো ক্লিনিকে আসেন না।
নওগাঁ জেলার মহাদেবপুর উপজেলার চান্দাশ কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি বিলকিস আক্তার বলেন, স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবারকল্যাণ সহকারীকে আরও দুটি কমিউনিটি ক্লিনিকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাঁরা এই ক্লিনিকে সপ্তাহে এক দিন বা দুই দিন আসেন।
মানিকগঞ্জের হিজুলিয়া কমিউনিটি ক্লিনিকে স্বাস্থ্য সহকারী আসেন না, ঘিওর কমিউনিটি ক্লিনিকে পরিবারকল্যাণ সহকারী ও স্বাস্থ্য সহকারী আসেন না এবং বাস্টিয়া কমিউনিটি ক্লিনিকে দীর্ঘদিন ধরে সিএইচসিপি ও পরিবারকল্যাণ সহকারীর পদ শূন্য।
নোয়াখালীর অনন্তপুর, উত্তর সাহাপুর, মাছিমপুর ও পূর্ব অম্বনপুর কমিউনিটি ক্লিনিকের কোনোটিতে স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবারকল্যাণ সহকারী ঠিকমতো আসেন না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এ ধরনের অভিযোগ অর্ধেকের বেশি কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে পাওয়া গেছে। জনবল না থাকায় অনেক এলাকার মানুষ সেবা পাচ্ছেন না। তাঁদের যেতে হচ্ছে উপজেলা সদরে বা জেলা শহরে। এতে তাঁদের সময় বেশি যাচ্ছে, ব্যয় বাড়ছে।
কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে পানি ও বিদ্যুৎ থাকার পাশাপাশি ব্যবহার উপযোগী টয়লেট থাকার কথা। কিন্তু সব ক্লিনিকে এই তিনটির কার্যকর উপস্থিতি দেখতে পাননি প্রথম আলোর সাংবাদিকেরা। দেখা গেছে, ঠিকাদার পানির পাম্প বসালেও পানি ওঠে না। অনেক ক্লিনিকে বিদ্যুৎ নেই। বিদ্যুৎ থাকলেও বৈদ্যুতিক পাখা নেই।
প্রতিটি ক্লিনিকে টয়লেট আছে। তবে অর্ধেকের বেশি ক্লিনিকে দেখা গেছে, টয়লেট ব্যবহারের উপযোগী নয়। কিছু ক্লিনিকে পানি না থাকার কারণে টয়লেট মানুষের ব্যবহারের পর্যায়ে নেই।
ক্লিনিকগুলোতে শুধু পানি, বিদ্যুৎ বা টয়লেটের সমস্যা নয়, আরও কিছু বিষয়ের ঘাটতি প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের চোখে পড়েছে। ক্লিনিকগুলোতে গ্লুকোমিটার দেওয়া হয়েছে গ্রামীণ মানুষের রক্তে শর্করা পরিমাপ করার জন্য। দেশে মানুষের মধ্যে ডায়াবেটিস বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে এবং ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় সহায়তা করার জন্য প্রতিটি ক্লিনিকে গ্লুকোমিটার দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মাত্র চারটি কমিউনিটি ক্লিনিকে গ্লুকোমিটার ব্যবহৃত হতে দেখা গেছে। বাকিগুলোর যন্ত্র নষ্ট অথবা যন্ত্রে ব্যবহৃত স্ট্রিপ না থাকার কারণে মানুষ সেবা পাচ্ছেন না।
জনস্বাস্থ্যবিদ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়াটারএইড দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের প্রতিনিধি খায়রুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে মানুষকে প্রয়োজনীয় ও পর্যাপ্ত সেবা দেওয়া দরকার। এতে মানুষের স্বাস্থ্য ব্যয় কমবে। দ্বিতীয়ত, ক্লিনিকগুলোর সঙ্গে জনসম্পৃক্ততা বাড়ালে, অর্থাৎ কমিউনিটি গ্রুপগুলোকে সক্রিয় করলে ছোটখাটো দুর্বলতা দূর হবে। এ ব্যাপারে সিভিল সার্জন ও কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন।
(সরেজমিন ঘুরে প্রতিবেদন তৈরি করেছেন মাহমুদুর রহমান, ঝালকাঠি; রাজিউর রহমান, পঞ্চগড়; সরদার ইনজামামুল হক, বাগেরহাট; আব্দুল মোমিন, মানিকগঞ্জ; মোস্তাফিজুর রহমান, ময়মনসিংহ; মাহবুবুর রহমান, নোয়াখালী; খলিল রহমান, সুনামগঞ্জ ; ওমর ফারুক, নওগাঁ।)