‘ঘুরে এলাম খুলনা শহর রূপসা নদীর তীরে, রূপসা নদীর রূপের মায়া ডাকে ফিরে ফিরে, পুরোনো এই নগরী তো ইতিহাসে ভরা, যেমন তাহার গুণের বাহার রূপেতেও সে সেরা।’ খুলনা শহরকে নিয়ে এমন ছন্দে ছন্দে কবিতা লিখেছেন অবিরুদ্ধ মাহমুদ। কবিতার নাম দিয়েছেন ‘ঘুরে এলাম খুলনা’।
আসলেই খুলনা এক মায়ার শহর, সমৃদ্ধ শহর, কোলাহলমুক্ত নির্মল শ্বাস নেওয়ার শহর। যেখানে নদী গল্প বলে আর খাল গেয়ে ওঠে ইতিহাসের গান। বহুকাল আগে, যখন পদ্মা ও মেঘনার মিলিত স্রোতে দক্ষিণ বাংলার বুক চিরে বয়ে চলত রূপসা, ভৈরব আর আটরা খাল, তখন এই অঞ্চল ছিল নিবিড় বনভূমি ও জলাভূমির এক বিস্ময়কর মিশেল। ইতিহাস বলে, খুলনার গোড়াপত্তন হয়েছিল নদীপথকে ঘিরেই। স্থানীয় লোককথা, প্রত্নতত্ত্ব ও সাহিত্যিক দলিল মিলিয়ে খুলনার জন্মকথা যেন এক রূপকথারই প্রতিচ্ছবি।
‘খুলনা’ নামকরণটি নিয়েও অনেক কিংবদন্তি ও গল্প প্রচলিত আছে। অনেকের মতে, ‘খুলনা’ নামটি এসেছে ‘খুল্লতন নগর’ থেকে, যেখানে দেবতা শিবের পূজা–অর্চনা হতো। আবার কারও মতে, ‘খুল’ মানে জলপথ বা খাল, আর ‘না’ মানে নদীর প্রবাহ থামা। অর্থাৎ যেখানে খাল থেমে নদীতে মেশে, সেখান থেকেই নাম হয়েছে ‘খুলনা’।
খুলনার পুরাকীর্তি নামে একটি বই লিখেছেন মিজানুর রহমান। তিনি বর্তমানে ঢাকার সরকারি তিতুমীর কলেজের উপাধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত। তিনি বলেন, এক সওদাগরের দুই মেয়ে ছিল। এক মেয়ের নাম খুল্লনা ও আরেকজনের নাম ছিল অহনা। ধারণা করা হয়, ওই সওদাগর তাঁর মেয়ের নামানুসারে শহরের নাম রাখেন খুলনা। এ ছাড়া সপ্তদশ শতকে খুলনার ভৈরব নদ থেকে ডুবে যাওয়া জাহাজ উদ্ধার করা হয়। সেই জাহাজের গায়ে Culna শব্দটি লেখা ছিল। ব্রিটিশ আমলে যে মানচিত্র তৈরি করা হয়, সেখানেও খুলনাকে Culna লেখা হয়।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৫ শতকে সুফি সাধক খানজাহান আলী যখন দক্ষিণ বাংলায় আসেন, তখন তিনি সুন্দরবনের প্রান্তঘেঁষা এ অঞ্চলটিকে সভ্যতার আলোয় আলোকিত করেন। তাঁরই নেতৃত্বে খনন করা হয় নানা দিঘি, খাল ও রাস্তা। ‘ডাকাতদের জনপদ’ থেকে ‘আধ্যাত্মিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র’—এই রূপান্তরের শুরু সেখান থেকেই।
কীভাবে খুলনা জেলার সৃষ্টি—সে সম্পর্কে একটি ধারণা দেন গবেষক, লেখক ও সাংবাদিক গৌরাঙ্গ নন্দী। তিনি বলেন, দক্ষিণ জনপথ ছিল যশোর জেলার অধীন। ১৮৪২ সালে যশোর জেলার প্রথম মহকুমা সৃষ্টি হয় খুলনা নামে। যেটি বাংলারও প্রথম মহকুমা। ওই মহকুমার প্রথম ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ১৮৬৩ সালে বাগেরহাট মহকুমার সৃষ্টি। এর দুই বছর আগে ১৮৬১ সালে সাতক্ষীরা মহকুমার সৃষ্টি, যা ছিল চব্বিশ পরগনা জেলাভুক্ত। খুলনা জেলা সৃষ্টির জন্য ১৮৮২ সালে কলকাতা থেকে তিনটি গেজেট নোটিফিকেশন প্রকাশ করা হয়। সর্বশেষ ২৫ এপ্রিল যশোর জেলার খুলনা ও বাগেরহাট এবং চব্বিশ পরগনা জেলার সাতক্ষীরা মহকুমা নিয়ে খুলনা জেলা সৃষ্টির নোটিশ জারি হয়। জেলার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ১ জুন। জেলা সদর হয় খুলনা। যেহেতু জেলার কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় ১ জুন, সেই হিসাবে ওই দিনটিকে খুলনা জেলার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী হিসেবে পালন করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
জেলা প্রতিষ্ঠার দুই বছর পর ১৮৮৪ সালে গঠিত হয় খুলনা পৌরসভা। প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন রেভারেন্ড গাগন চন্দ্র দত্ত। তৎকালীন পৌরসভায় দশজন নির্বাচিত সদস্য, চারজন উপ-আধিকারিক এবং অন্য একজন মনোনীত সদস্য সমন্বয়ে ১৫ সদস্যের একটি বোর্ড ছিল। ১৯৮৪ সালে পৌরসভাকে মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এরপর ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় খুলনা সিটি করপোরেশন।
পৌরসভা থাকাকালে খুলনার বুকে গড়ে উঠছিল ঘাট, গুদাম, রেলস্টেশন, আর নদীপথকেন্দ্রিক বাণিজ্যকেন্দ্র। রূপসা নদীর পারে তখন সন্ধ্যা নামত ঘণ্টার শব্দে, আর জাহাজের সাইরেনে ঘোষণা হতো নতুন দিনের শুরু। পাকিস্তান আমলে খুলনা হয়ে ওঠে শিল্প শহর। গড়ে ওঠে খুলনা শিপইয়ার্ড, হার্ডবোর্ড মিলস, টেক্সটাইল মিলস, আর নিউজপ্রিন্ট মিলস, যা এই শহরের অর্থনীতির চাকা ঘুরিয়ে দেয়। রূপসার পারে গড়ে ওঠা এই শহর যেন এক স্বপ্নের নাম হয়ে ওঠে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের কাছে।
বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ উজ জামান বলেন, ২৬টি শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় খুলনা শহর থেকে প্রায় দুই লাখ মানুষ অন্যত্র চলে গেছেন। ২০১২ সাল থেকে খুলনায় গ্যাস সরবরাহের জন্য পাইপলাইন বসানোর কাজ শুরু হয়। কিন্তু এখনো খুলনাবাসী গ্যাস থেকে বঞ্চিত। গ্যাস না থাকায় খুলনায় নতুন করে কোনো শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে না। বিমানবন্দর না থাকায় বৈদেশিক বিনিয়োগকারীরা খুলনা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। খুলনায় কর্মসংস্থানের কোনো ব্যবস্থা নেই। এসব পাওয়া গেলে নতুন করে আবার খুলনা উজ্জীবিত হবে। মানুষের কর্মসংস্থান বাড়বে।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর কলকাতার বারাসাত থেকে খুলনায় চলে আসে সৈয়দ মনোয়ার আলীর পরিবার। প্রথমে তাঁরা ওঠেন সেনহাটিতে। সেখানে থেকে ১৯৫০ সালের দিকে চলে আসেন খুলনা শহরে। টিনশেডের একটি ভাড়া বাড়িতে ছয় ভাইবোনসহ ৯ জন থাকতেন তাঁরা। তখন মনোয়ার আলীর বয়স ছিল ১০-১১ বছরের মতো। এখন তাঁর বয়স ৮২ বছর। সেই সময়ের খুলনা শহরের একটি চিত্র প্রথম আলোর কাছে তুলে ধরেন তিনি।
মনোয়ার আলী বলেন, ওই সময়ই গোছালো একটি শহর ছিল খুলনা। সড়কে বিদ্যুতের বাতি ছিল, পানি ছিল। শহরের মধ্যে ছিল পাকা রাস্তা। তবে সড়কগুলো বেশ সরু। বাড়িগুলো ছিল ফাঁকা ফাঁকা, ঘিঞ্জি ভাব ছিল না। অধিকাংশ ছিল দ্বিতল বাড়ি। বাড়ির নকশাতেও ছিল আভিজাত্যের ছোঁয়া। অধিকাংশ বড় বাড়ি ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের।
মনোয়ার আলী বলেন, সনাতন ধর্মের লোকেরা বাড়িঘর ছেড়ে চলে যাওয়ায় প্রথম দিকে শহর দেখে মনে হতো ভাঙা হাট। বড় বড় বাড়ি পড়ে আছে; কিন্তু লোকজন নেই। শহরের মধ্যে প্রচুর গাছপালা ও পুকুর ছিল। রিকশা ছিল হাতে গোনা। বড় লোকের বাহন ছিল ঘোড়ার গাড়ি। যার বেশি ঘোড়ার গাড়ি থাকত তাঁকে বেশি ধনী হিসেবে গণ্য করতেন মানুষ। সাংস্কৃতিকভাবেও খুলনা ছিল বেশ সমৃদ্ধ।
আজকের খুলনা শুধু শহর নয়, ইতিহাসের নদীতীরে দাঁড়ানো এক জীবন্ত অনুরণন। এখানে খানজাহান আলীর মাজারের ধোঁয়া মিশে থাকে শহরের বাতাসে, আর রূপসা সেতুর ওপর দাঁড়ালে এখনো যেন শোনা যায় শত বছর আগের নৌকার পাল তুলে চলার আওয়াজ।
খুলনার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী নিয়ে নানা ধরনের মতবাদ থাকলেও প্রতিবছর ২৫ এপ্রিল বেশ ঘটা করে খুলনা জেলার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্যাপন করে বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি। বর্ণাঢ্য আনন্দ শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা, আপ্যায়ন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে সংগঠনটি। এবারও দিনটি উপলক্ষে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।