
কক্সবাজার সাগরদ্বীপ কুতুবদিয়া উপজেলার কৈয়ারবিল। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ে কুতুবদিয়া দ্বীপের পশ্চিমাংশের এই এলাকাটি লন্ডভন্ড হয়ে যায়। নিহত হয় চার হাজারের বেশি মানুষ। ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে সাগরে বিলীন হয়েছিল এই ইউনিয়নের অন্তত দেড় হাজারের বেশি ঘরবাড়ি-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ নানা অবকাঠামো। পাশের আলী আকবরডেইল ইউনিয়নেও ঘূর্ণিঝড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় ৯ নম্বর ওয়ার্ডের খুদিয়ারটেকসহ কয়েকটি গ্রামের ১০ হাজার ঘরবাড়ি। ভয়াল এই ঘূর্ণিঝড়ের পর তিন দশক পার হলেও এখনো জলোচ্ছ্বাস ঠেকানোর মতো টেকসই বেড়িবাঁধ পাননি ইউনিয়ন দুটির বাসিন্দারা।
প্রতিবছর ২৯ এপ্রিল এলেই উপকূলের ঘরে ঘরে কান্নার রোল পড়ে যায়, স্বজন হারানোর বেদনায় সিক্ত হন বাসিন্দারা। বিভীষিকার সেই রাত তাড়া করে তাঁদের। প্রতিবছরের মতো এবারও দিবসটি ঘিরে কুতুবদিয়ায় সভা, মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয়ে আসছে। এসব কর্মসূচিতে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ এবং দ্বীপের জন্য ফেরি সার্ভিস চালুর দাবি তোলেন বাসিন্দারা।
স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, বিদ্যমান ভাঙা বেড়িবাঁধটি সংস্কারের নামে টাকা খরচ হলেও তার সুফল পাচ্ছে না দ্বীপের মানুষ। গত তিন বছরে ভাঙা বেড়িবাঁধ সংস্কারের জন্য প্রায় ২৫০ কোটি টাকা খরচ করা হলেও এখনো ৭-৯ কিলোমিটার বাঁধ ভাঙা অবস্থায় পড়ে আছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ১৯৯১ সালের ২২ এপ্রিল বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপটি ২৪ এপ্রিল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়। ক্রমশ শক্তি সঞ্চয় করে ঘূর্ণিঝড়টি ২৯ এপ্রিল রাতে ঘণ্টায় ২৫০ কিলোমিটার (১৫৫ মাইল) বেগে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম উপকূলে আঘাত হানে। এর প্রভাবে সৃষ্ট ৬ মিটার (২০ ফুট) উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে কুতুবদিয়াসহ উপকূলীয় এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। সরকারি হিসাবে, ঘূর্ণিঝড়ে দেশের ১৯টি উপকূলীয় জেলায় ১০২টি উপজেলায় মৃত্যু হয়েছিল ১ লাখ ৩৮ হাজার ৮৮২ জনের। ১০ লাখের বেশি ঘরবাড়ির বিলীন হওয়ায় আশ্রয়হীন হয়ে পড়েন ১ কোটির বেশি মানুষ। ঘূর্ণিঝড়ে কক্সবাজার জেলাতে মৃত্যু হয়েছিল ৮৪ হাজার মানুষের। এর মধ্যে কুতুবদিয়াতেই মারা গেছেন ১৮ হাজার।
বেড়িবাঁধে বিপন্ন জীবন
কৈয়ারবিল ইউনিয়নের সাগর তীরবর্তী এলাকা হাজি মফজল মিয়াপাড়া ও মৌলভিপাড়া। গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, বেড়িবাঁধ সাগরে বিলীন হয়ে গেছে। আশপাশে বাঁশ-কাঠ-পলিথিন ও টিনের ছাউনিযুক্ত খুপরি তৈরি করে বসতি করছে মানুষ। বাসিন্দারা জানান, নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত পাঁচ মাস সাগর কিছুটা শান্ত থাকে। এপ্রিল-মে থেকে বছরের অবশিষ্ট সাত মাস উত্তাল থাকে সাগর। তখন দেখা দেয় নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ-ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস। তখন আতঙ্কে দিন কাটে তাঁদের।
সরেজমিন দেখা যায়, জোয়ারের পানিতে বেশ কিছু ঘর প্লাবিত হচ্ছে। ঘরের উঠানে রোপণ করা কিছু নারকেলগাছ সাগরে বিলীন হওয়ার পথে। এর মধ্যেই সৈকতে উৎপাদন হচ্ছে শুঁটকির। শুঁটকি মহালের পাশে ছোট্ট একটি খুপরিতে বসবাস করেন বৃদ্ধা লায়লা বেগম। জীবনে তিনি ৬০টির বেশি ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস দেখেছেন বলে জানান। ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়ে নিজের চার মেয়েকে হারিয়েছেন জানিয়ে লায়লা বেগম (৬৭) প্রথম আলোকে বলেন, সাগরে দিন দিন বিলীন হচ্ছে দ্বীপ। গত তিন দশকে বসতবাড়ি ও পেশা হারিয়ে দ্বীপের ৬০ থেকে ৭০ হাজার মানুষ অন্য স্থানে চলে গেছেন। যাঁরা রয়ে গেছেন, সবাই আশায় বুক বেঁধে আছেন কখন একটি টেকসই বেড়িবাঁধ হবে।
লায়লা বেগম বলেন, ১৯৯১-এর ঘূর্ণিঝড়ের আগে তাঁর বসতবাড়ি ছিল দুই কিলোমিটার পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের মধ্যেই। তখন তার পাঁচ কানি (দুই একর) জমি ও বসতঘর ভেসে গিয়েছিল। গত তিন দশকে তিনি চারবার ঘর পাল্টিয়েছেন। এখন যে ঘরে থাকছেন, সেটিও জলোচ্ছ্বাসের প্লাবিত হয়।
লায়লা বেগমের ছেলে ফরিদুল আলম (৪৬) বলেন, বর্ষাকালে গ্রামের কয়েক হাজার মানুষকে চরম আতঙ্কে দিন কাটাতে হয়। দুর্যোগের সংকেত পড়লেই শুরু করতে হয় নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে দৌড়ঝাঁপ।
ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ের ৩৪ বছর অতিক্রান্ত হলেও সেই রাতের বিভীষিকা ভুলতে পারেননি হাজি মফজল পাড়ার কৃষক আলী হোসেনও (৫৮)। ঘূর্ণিঝড়ে সময় তিনি দুই ভাই, দুই বোন ও তিন সন্তানকে হারিয়েছেন। বর্তমানে স্ত্রী ও চার ছেলেমেয়ে নিয়ে আলী হোসেনের সংসার। আলী হোসেন বলেন, তাঁর বাড়িটি যে জায়গায় ছিল, এখন সেখানে জাহাজ নোঙর করে। জায়গাটি তীর থেকে প্রায় ২ কিলোমিটার দূরে। জলোচ্ছ্বাসে ভিটেবাড়ি বিলীন হওয়ায় গত ২৬ বছরে তিনি চারটি ঘর পাল্টিয়েছেন। এবার ঘরটি বিলীন হলে আর কোথাও যাওয়ার মতো জায়গা থাকবে না।
জলোচ্ছ্বাস থেকে ঘরগুলো রক্ষার বেড়িবাঁধ নেই জানিয়ে কৈয়ারবিলের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মীর কাশেম বলেন, হাজি মফজল ও মৌলভিপাড়াসহ পুরো ওয়ার্ডে জলবায়ু উদ্বাস্তু ৪৫০টি পরিবার ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে দুই যুগের বেশি সময় ধরে। ব্যক্তি উদ্যোগে সৈকত এলাকায় অস্থায়ী বেড়িবাঁধ তৈরি করে ঘরবাড়িগুলো রক্ষার চেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু স্থায়ী বেড়িবাঁধ হচ্ছে না। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষার জন্য গ্রামগুলোয় একটি ঘূর্ণিঝড়কেন্দ্রও নেই।
কৈয়ারবিলের দক্ষিণ পাশে আলী আকবরডেইল ইউনিয়ন। ১৯৯১-এর ঘূর্ণিঝড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এই ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের খুদিয়ারটেক। সম্প্রতি সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, এলাকাটিতে কোনো বসতি নেই। কুতুবদিয়ার আলী আকবর ডেইল কবি জসিম উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক আবুল কাশেম (৬৪) বলেন, তাঁর বাড়ি ছিল খুদিয়ারটেকে। ৯১ এর ঘূর্ণিঝড়ে তাঁর বাড়িটি সমুদ্রে বিলীন হলে তিনি আলী আকবর ডেইল গ্রামে ঘর নির্মাণ করেন। তিনি বলেন, ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়ে বেড়িবাঁধ ভেঙে কুতুবদিয়া উপজেলাতেই প্রায় ২০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। অথচ এখনো তা অরক্ষিত থেকে গেছে।
খুদিয়ারটেকের বক্তার পাড়ার বাসিন্দা মো. নেছারুল হক (৬২) বলেন, ৯১–এর ঘূর্ণিঝড় তাঁর ২৮ কানি ধানি জমিসহ বসতভিটা সাগরে হারিয়ে যায়। এরপর তিনি আশ্রয় নেন আলী আকবর ডেইল গ্রামে। কুতুবদিয়ায় প্রথম বেড়িবাঁধ হয়েছিল ১৯৬০ সালে। বাঁধের উচ্চতা ছিল পাঁচ-ছয় ফুট। ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস খুদিয়ারটেকের পশ্চিম অংশের আড়াই কিলোমিটার ও দক্ষিণের সাড়ে ৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে ফেলে। এখন খুদিয়ারটেকের ৩ হাজার একর বিরানভূমি পড়ে থাকলেও সেখানে কোনো বেড়িবাঁধ নেই, নেই প্যারাবন।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুতুবদিয়া উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম বলেন, এখন যদি ১৯৯১-এর মতো শক্তিশালী একটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে তাহলে কুতুবদিয়ার কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। কারণ, দ্বীপের চারদিকে ৪০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে লেমশিখালী অংশে ৩০০ একরের মতো প্যারাবন আছে। তা–ও লবণ চাষের জন্য নিধন করা হচ্ছে। কুতুবদিয়াবাসীর এখন একটাই দাবি, টেকসই বেড়িবাঁধ এবং নিরাপদ যাতায়াতের জন্য পাঁচ কিলোমিটার প্রস্থের কুতুবদিয়া চ্যানেলে ফেরি সার্ভিস চালু করা।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কোস্ট ফাউন্ডেশন চেয়ারম্যান ও কুতুবদিয়ার বাসিন্দা রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি, প্রতিনিয়ত দুর্যোগের আঘাত, তাপমাত্রা ও লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় উপকূলীয় মানুষের জীবন-জীবিকা হুমকিতে পড়েছে। সাগর গর্ভে বিলীন হতে হতে দ্বীপের আয়তন এখন ২৫ বর্গকিলোমিটারে ঠেকেছে। গত তিন দশকে বাস্তুচ্যুত হয়ে কিংবা পেশা হারিয়ে ৬০ হাজারের বেশি মানুষ দ্বীপ ছেড়েছেন। দ্বীপে থেকে যাওয়া দেড় লাখ মানুষের নানা সংকটে দিন কাটছে। টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ, জীবিকার বিকল্প ব্যবস্থা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিকর দিক মোকাবিলায় নানামুখী উদ্যোগ না নিলে সংকট আরও বাড়বে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নুরুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে কুতুবদিয়াসহ জেলের বিভিন্ন উপকূলে ১৭টি অংশে কয়েক কিলোমিটার ভাঙা বেড়িবাঁধ রয়েছে। আসন্ন বর্ষার আগে ভাঙা অংশসমূহ সংস্কারের জন্য ৫০ কোটি টাকার চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। তিনি আরও বলেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় কুতুবদিয়াতে ৪০ কিলোমিটারের সুপার ডাইক বাঁধ নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল। সমুদ্রপৃষ্ট থেকে ১০ মিটার উচ্চতায় প্রস্তাবিত সুপার ডাইকের ওপরে দুই লেনের সড়ক, দুই দিকের ঢালুতে সিসি ব্লক বসানোর কথা ছিল। তবে সুপার ডাইক প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে।
পাউবো সূত্র জানায়, কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামের মিরসরাই এবং ফেনী থেকে নোয়াখালীর রহমতখালী পর্যন্ত ৬৪২ কিলোমিটার উপকূল সুরক্ষায় সুপার ডাইক নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ার কথা। জলবায়ু তহবিলের ৮০ হাজার ১৩২ কোটি ৮৩ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কথা থাকলেও তহবিল সংগ্রহ না হওয়ায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সুপার ডাইক প্রকল্পের কুতুবদিয়া অংশে পড়েছিল ৬৩ কিলোমিটার উপকূল।