২০২৩ সালে সিলেটে প্রকাশিত প্রীতি-উপহার ও ১৯৭৯ সালে সিলেটে মুদ্রিত প্রীতি-উপহার
২০২৩ সালে সিলেটে প্রকাশিত প্রীতি-উপহার ও ১৯৭৯ সালে সিলেটে মুদ্রিত প্রীতি-উপহার

স্মৃতির পাতায় ‘প্রীতি–উপহার’

আত্মীয়স্বজনের বিয়ের আগে রাত জেগে কাব্য লিখে ‘প্রীতি–উপহার’ তৈরি করতেন কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের বাবা। নিজ হাতে কাগজে লিখে একাধিক কপি প্রস্তুত করতেন। বিয়ের আসরে এ কাব্য পাঠ করে শোনাতেন পুত্র হুমায়ূন। পরে হস্তলিখিত এমন প্রীতি–উপহারের কপি জনে জনে বিলি করা হতো।

এই গল্প হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক বই কাঠপেন্সিল–এ (২০০৯)। তিনি আরও লিখেছেন, ‘আমাকে প্রীতি–উপহার নিয়ে পাঠানো হতো মেয়েমহলে। কনেকে ঘিরে থাকত তার বান্ধবীরা। তারা তখন আমাকে নিয়ে নানান রঙ্গরসিকতা করত। আমি যথেষ্ট আবেগ দিয়ে প্রীতি–উপহার পড়ছি, এর মধ্যে কেউ একজন বলে বসল, “এই বান্দর, চুপ কর।” মেয়েরা সবাই হেসে এ–ওর গায়ে জড়িয়ে পড়ত।’

একটা সময়ে বিয়ের অনুষ্ঠানে প্রধান অনুষঙ্গ ছিল এই ‘প্রীতি–উপহার’। এমন রীতির প্রচলন বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সুদীর্ঘকাল ধরেই ছিল। প্রথমে হস্তলিখিত, পরে লেটারপ্রেসে মুদ্রিত হতো এসব প্রীতি–উপহার। বিশেষত সিলেটসহ হাওরাঞ্চলের গ্রামে বিয়ে উপলক্ষে অহরহ প্রীতি–উপহার প্রকাশিত হতো। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত এ প্রবণতা ব্যাপকভাবে ছিল। চুটকি, ছড়া, কবিতা, কৌতুক, খেতাব, প্যারোডি কবিতা, গানসহ নানা ধরনের রসাত্মক লেখা আর রঙ্গরসিকতা বর-কনেকে নিয়ে মুদ্রিত হতো ‘প্রীতি–উপহার’ স্মরণিকায়।

হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন, ‘বর-কনেকে আশীর্বাদ এবং বরণসূচক ছড়ার সংকলনই “প্রীতি–উপহার”। সস্তা কোনো প্রেস থেকে এই জিনিস ছাপা হয়ে আসত। শুরুতে ছবি-মেহেদিপরা একটা হাত পুরুষের গরিলাটাইপ রোমশ হাতকে হ্যান্ডশেক করছে। কিংবা একটি কিশোরী পরি ফুলের মালা হাতে আকাশে উড়ছে।’ প্রীতি–উপহার না ছাপানোর কারণে তাঁর এক আত্মীয়ের বিয়ে ভেঙে যাওয়ার তথ্যও তিনি ওই লেখায় দিয়েছেন।

সিলেটে বিয়ের গানের জনপ্রিয় একজন গীতিকার হলেন প্রয়াত গিয়াসউদ্দিন আহমদ। তাঁর অসংখ্য গানও ‘প্রীতি–উপহার’-এ মুদ্রিত হয়েছে। ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়’ গানের এই গীতিকারের ছেলে সাংস্কৃতিক সংগঠক ও নাট্যকার মু. আনোয়ার হোসেন রনি জানান, সারা দেশেই প্রীতি–উপহার প্রকাশের রেওয়াজ ছিল। তবে সিলেট অঞ্চলে এটা ঘটা করে প্রকাশ করা হতো। হিন্দু, মুসলিম উভয় সম্প্রদায় বিয়ে উপলক্ষে এমন প্রকাশনা বের করতেন। এটা উৎসবকে আরও বর্ণিল করে তুলত।

সত্তর ও আশির দশকে আনোয়ার হোসেন সিলেট অঞ্চলের অনেক বিয়ের আয়োজন দেখেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি জানান, এখনকার মতো আগে বিয়ে এতটা চাকচিক্যময় ছিল না। হলুদ মেখে কন্যা গোসল, জামাই গোসল দেওয়া, বিয়ের গীত পরিবেশন আর বিয়ে উপলক্ষে প্রকাশিত প্রীতি–উপহারই সবার কাছে ছিল আনন্দের উপলক্ষ। আগেকার ধারা টিকিয়ে রাখতে তিনি দুই বছর আগে তাঁর ছেলের বিয়েতে ‘জরির শেওরা’ নাম দিয়ে প্রীতি–উপহার প্রকাশ করেছেন। চলতি মাসে তাঁর ভাগনির বিয়েতেও একই রকমভাবে প্রীতি–উপহার প্রকাশ করেছেন।

বিয়ে মানেই যেহেতু আনন্দ-উচ্ছ্বাসে মানুষজন ভেসে যেতেন, ফলে প্রীতি–উপহার বিয়েতে নতুন এক মাত্রা যোগ করত। কেউ কেউ অবশ্য এসব স্মরণিকাকে ‘প্রীতির ডালা’, ‘প্রীতি নিবেদন’, ‘মধুর মিলন’, ‘বিয়ে পরীক্ষা’, ‘বিয়ের অর্ঘ্য, ‘লাভ স্টোরি’, ‘আশীর্বাদ’, ‘দোয়া’, ‘স্নেহ উপহার’, ‘আনন্দ-উচ্ছ্বাস’ নামেও অভিহিত করতেন। আবার কোনো কোনো বনেদি পরিবারে বৃহৎ আকারে সংকলনও প্রকাশিত হতো। মূলত বিয়েবাড়িতে আসা অতিথিদের হাতে এসব তুলে দেওয়ার একটা ‘অলিখিত প্রথা’ ছিল।

কিছু ব্যতিক্রম বাদে ‘প্রীতি–উপহার’-এর বেশির ভাগ লেখক হচ্ছেন বর-কনের আত্মীয়স্বজন। বিশেষত ভাবি, শালা-শালি, দেবর, বন্ধুবান্ধবীসহ নানা ‘কুটুম’। তাঁদের ‘কাঁচা হাতে’র লেখায় ধরা পড়ত বর-কনেকে নিয়ে তাঁদের অনুভূতি, আবেগ আর হাসিঠাট্টা। পাশাপাশি স্মরণিকায় বড়দের ‘দোয়া’ আর ছোটদের ‘ভালোবাসা’ও মুদ্রিত হতো। এ ছাড়া বিয়ের তারিখ, বর-কনের স্থায়ী-অস্থায়ী ঠিকানাও এতে থাকত।

সিলেটের ঐতিহ্য-সংগ্রাহক শিশির কুমার নাথের সংগ্রহে এ অঞ্চলে সত্তর ও আশির দশকে প্রকাশিত বেশ কিছু ‘প্রীতি–উপহার’-এর কপি আছে। তিনি জানান, বিশেষ করে সত্তর ও আশির দশকে রঙিন কাগজে মুদ্রিত লিফলেট-জাতীয় প্রীতি–উপহার কিংবা পুস্তিকা প্রকাশের রেওয়াজ ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। এটা বিয়েবাড়ির মর্যাদা অনেকটা বাড়িয়ে দিত। লেখা নিয়ে আলোচনা ও গুঞ্জন চলত বিয়েবাড়িতে।

শিশির কুমার জানালেন, তখন প্রেসগুলোতেও প্রীতি–উপহারের নমুনা রাখা হতো। ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখার আনন্দও তখন কম ছিল না। আশির দশকে তাঁর বাবার বিয়েতেও এমন প্রীতি–উপহার প্রকাশিত হয়েছিল। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত এর জনপ্রিয়তা ছিল।

কবি শামসুর রাহমানের বিয়েতেও ‘জীবনের আশ্চর্য ফাল্গুন’ নামে প্রীতি–উপহার প্রকাশিত হয়েছিল। এতে অনেক কবি লিখেছিলেন। কবি নিজেই তাঁর প্রীতি–উপহারের নামকরণ করেন। সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন তাঁর প্রেসে এটা ছেপেছিলেন। তবে ধীরে ধীরে আবেদন ফুরিয়েছে। এই ঐতিহ্য প্রায় তলানিতে ঠেকেছে। এরপরও মাঝেমধ্যে শখের বশে কেউ কেউ পুরোনো রীতি ফিরিয়ে আনতে এখনো ‘প্রীতি–উপহার’ প্রকাশ করে চলেছেন।