কক্সবাজার সৈকতে বসে সেলফি তুলতে ব্যস্ত এক পর্যটক পরিবার। বিনোদনের সুযোগ–সুবিধা নিয়ে এখানে আসা অনেক পর্যটকের অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি সুগন্ধা সৈকতে
কক্সবাজার সৈকতে বসে সেলফি তুলতে ব্যস্ত এক পর্যটক পরিবার। বিনোদনের সুযোগ–সুবিধা নিয়ে এখানে আসা অনেক পর্যটকের অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি সুগন্ধা সৈকতে

কক্সবাজার থেকে বিদেশি পর্যটকেরা কেন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন

কক্সবাজারের পর্যটন এখনো সাগরকেন্দ্রিক রয়ে যাওয়ায় আসছেন না বিদেশি পর্যটকেরা। নিরাপদ সৈকত, দূষণমুক্ত পরিবেশ ও বিনোদন সুবিধা না থাকায় এখানে আসতে উৎসাহিত হন না নানা দেশের পর্যটকেরা।

কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের সঙ্গে ফজলুল কাদের চৌধুরীর (৬৫) পরিচয় পাঁচ দশকের। শহরের ঝাউতলা এলাকার এই বাসিন্দা প্রায় প্রতি সপ্তাহেই সৈকতে যান। সমুদ্রের পরিবেশ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং নিরাপত্তা নিয়ে তাঁর লেখালেখি ও গবেষণাও কম নয়।

ফজলুল কাদের প্রথম আলোকে বলেন, তিন দশক আগেও সমুদ্রসৈকতের লাবণী পয়েন্টে বিদেশি পর্যটকেরা আসতেন। কিন্তু নানা অব্যবস্থাপনার কারণে ধীরে ধীরে বিদেশিরা আসা বন্ধ করে দেন। গত কয়েক বছরে তিনি সৈকতে বিদেশি পর্যটকের মুখ দেখেননি বলে জানান।

একই অভিজ্ঞতার কথা বলেন কক্সবাজার আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আয়াছুর রহমান (৬৫)। তিনি বলেন, গত চার দশকে দুই বর্গকিলোমিটার জায়গাজুড়ে পাঁচ শতাধিক হোটেল, রিসোর্ট, গেস্টহাউস গড়ে তোলা হয়েছে। বিদেশিদের এক দিনও ধরে রাখার মতো বিনোদন ব্যবস্থা নেই। অতীতে দেখা গেছে, কোনো বিদেশি সৈকতে নামলে স্থানীয় লোকজন ভিড় করে উত্ত্যক্ত করতেন, ছবি তুলতেন। নিরাপত্তা ও পরিবেশবান্ধব ইকোট্যুরিজম প্রতিষ্ঠান না থাকায় বিদেশি পর্যটক আর টানা যাচ্ছে না। তবে তিনি জানান, মেরিন ড্রাইভের মারমেইড বিচ রিসোর্টসহ কিছু পরিবেশবান্ধব স্থাপনায় এখনো হাতে গোনা কয়েকজন বিদেশি আসেন।

অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও পরিবেশ সংকট

বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারে বিদেশি পর্যটক না আসার পেছনে মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে অপরিকল্পিত নগরায়ণ, পরিবেশ সংকট এবং সরকারি-বেসরকারি সমন্বয়ের অভাবকে।

কক্সবাজার শহরের কলাতলী এখন কংক্রিটের জঙ্গল। পাঁচ শতাধিক হোটেল-রিসোর্ট ঘিঞ্জিভাবে দাঁড়িয়ে আছে। সৈকত রক্ষায় অপরিকল্পিতভাবে জিও টিউব ব্যাগ বসানোয় বালুচর ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়েছে। সৈকতের বিভিন্ন স্থানে অগভীর গুপ্তখাল ও গর্তের কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে।

শহরের প্রধান সড়কগুলোতে যানজট নিত্যদিনের সমস্যা। সড়কের দুই পাশে অবৈধ দোকানপাট, ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। বৃষ্টিতে পর্যটন এলাকা, বিশেষ করে কলাতলী হোটেল-মোটেল জোন পানিতে তলিয়ে যায়। রাতে সড়কবাতি না থাকায় ভুতুড়ে পরিবেশ তৈরি হয়। সিসি ক্যামেরার বেশির ভাগই নষ্ট। ফলে চুরি-ছিনতাই বেড়ে গেছে।

ট্যুরিস্ট পুলিশের কক্সবাজার অঞ্চলের প্রধান অতিরিক্ত ডিআইজি আপেল মাহমুদ বলেন, বালিয়াড়ি দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ হয়নি। সৈকত ও প্রকৃতি দেখতেই পর্যটকেরা কক্সবাজার আসেন। অথচ এখানে এসে ঝুপড়ি, কংক্রিটের ভবন দেখে যে কেউ হতাশ হবেন।

কক্সবাজার সৈকত আন্তর্জাতিক মানের নিরাপদ পর্যটনকেন্দ্র হয়ে উঠতে পারেনি বলে মনে করেন পর্যটন–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। নেই বিনোদনের পর্যাপ্ত সুবিধাও। এ কারণে বিদেশি পর্যটকেরা এখানে আসেন না। গত শনিবার দুপুরে সুগন্ধা সৈকতে ঢাকার মগবাজারের ব্যবসায়ী তোফায়েল আহমদের সঙ্গে কথা হয়। স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে তিনি চার দিনের ছুটিতে এসেছেন। তোফায়েল আহমদ বলেন, সমুদ্র দেখা আর সূর্যাস্ত দেখা ছাড়া সময় কাটানোর কিছু নেই। পর্যটন বা বিনোদনের উন্নতি হয়নি। উল্টো যেটুকু সৌন্দর্য ছিল, তা নষ্ট হচ্ছে।

পর্যটকদের যত অভিযোগ

কক্সবাজার সৈকত আন্তর্জাতিক মানের নিরাপদ পর্যটনকেন্দ্র হয়ে উঠতে পারেনি বলে মনে করেন পর্যটন–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এ ছাড়া নেই বিনোদনের পর্যাপ্ত সুবিধাও। এ কারণে বিদেশি পর্যটকেরা এখানে আসেন না। গত শনিবার দুপুরে সুগন্ধা সৈকতে ঢাকার মগবাজারের ব্যবসায়ী তোফায়েল আহমদের সঙ্গে কথা হয়। স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে তিনি চার দিনের ছুটিতে এসেছেন। তোফায়েল আহমদ বলেন, সমুদ্র আর সূর্যাস্ত দেখা ছাড়া সময় কাটানোর কিছু নেই। পর্যটন বা বিনোদনের উন্নতি হয়নি। উল্টো যেটুকু সৌন্দর্য ছিল, তা নষ্ট হচ্ছে। তাই পর্যটনের প্রসার হচ্ছে না। অব্যবস্থার শিকার হচ্ছেন বেড়াতে আসা পর্যটকেরা।

সৈকতে নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কুমিল্লা থেকে আসা এক ব্যবসায়ী। ইকবাল মাহমুদ নামের ওই ব্যবসায়ী বলেন, সৈকতে নারীরা হেনস্তার শিকার হন। নিরাপদ বোধ না করলে কেন পর্যটকেরা আসবেন।

সৈকতে গোসলে নেমে প্রাণহানির ঘটনা যে হারে বাড়ছে, তা কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে বলে মনে করেন পর্যটকেরা। এ ছাড়া দ্রুতগতির জেটস্কি ও প্যারা সেইলিংয়ের কারণেও দুর্ঘটনা ঘটছে। স্রোতের টানে ভেসে গেলে উদ্ধারের জন্য সরকারি উদ্যোগে কোনো ডুবুরি পর্যন্ত নেই। চিকিৎসাকেন্দ্র নেই।

ঢাকার বাসিন্দা কামরুল ইসলাম বলেন, ভারত, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়ার তুলনায় কক্সবাজারের হোটেল ভাড়া এবং খাবারের দাম অনেক বেশি। কোনো নিয়ন্ত্রণ বা তদারকি নেই। বিদেশিরা কম দামে নিরাপদ জায়গা বেছে নেন।

কক্সবাজারের প্যাঁচার দ্বীপের পরিবেশবান্ধব মারমেইড ইকো-রিসোর্টে প্রকৃতি ও আধুনিকতার মেলবন্ধন ঘটেছে

অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা

কক্সবাজারে বিদেশি পর্যটকের জন্য আলাদা অঞ্চল গড়ে তোলা হয়নি। হোটেল রিসোর্ট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুকিম খান বলেন, কক্সবাজারে রাত্রিকালীন বিনোদনের ব্যবস্থা নেই। কেব্‌ল কার, টয় ট্রেন, লেক-শো, ডলফিন শো, অ্যামিউজমেন্ট পার্ক, শিশুপার্ক ছাড়াই গড়ে উঠেছে কক্সবাজারের পর্যটনশিল্প। এই শিল্পকে এগিয়ে নিতে এসব বিনোদনের সুবিধাও রাখতে হবে।

রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাবেদ ইকবাল বলেন, দুবাই, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া তাদের ছোট দ্বীপগুলো পর্যটনের জন্য উন্মুক্ত করেছে। এখানে অ্যাডভেঞ্চারের সুযোগ কম। তাই পর্যটকেরা বিনোদন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও কক্সবাজার কেবল সাগরনির্ভর পর্যটনেই সীমাবদ্ধ বলে মন্তব্য করেন কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী। তিনি বলেন, প্রশাসনিক জটিলতার কারণে নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে না। ইকোট্যুরিজম এবং বহুমুখী সুবিধা গড়ে তুলতে হবে পর্যটনশিল্পকে বাঁচাতে হলে।

ইকোট্যুরিজমে সম্ভাবনা

মেরিন ড্রাইভের মারমেইড বিচ রিসোর্ট কক্সবাজারে পরিবেশবান্ধব পর্যটনের সূচনা করেছে। কক্সবাজার শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে এই রিসোর্টে বিদেশি পর্যটকের সমাগম তুলনামূলক বেশি।

মারমেইডের প্রতিষ্ঠাতা আনিসুল হক চৌধুরী বলেন, ‘বিদেশি পর্যটক প্রকৃতি দেখতে কক্সবাজারে আসেন, কংক্রিটের জঙ্গল নয়। প্রকৃতিকে রক্ষা করে কীভাবে পর্যটন করা যায়, মারমেইড তার দৃষ্টান্ত।’

মারমেইডে বিচ কার্নিভ্যাল, বিচ ক্র্যাব ফেস্টিভ্যাল, লোকসংস্কৃতি উৎসব, চলচ্চিত্র প্রদর্শনীসহ নানা আয়োজন থাকে। মারমেইডের অনুকরণে গত পাঁচ-ছয় বছরে মেরিন ড্রাইভ ও সেন্ট মার্টিনে আরও ৫০-৫৫টি ইকো-রিসোর্ট গড়ে উঠেছে। ঢাকার ব্যবসায়ী মান্নান গাজী বলেন, মারমেইডে গ্রামীণ পরিবেশের সঙ্গে আধুনিক সুযোগ-সুবিধার সমন্বয় আছে। তাই বিদেশিরা সেখানে বেশি থাকেন।

ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি আপেল মাহমুদ বলেন, ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক মানের ফ্লাইট চালু হলে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা বাড়তে পারে। তবে অব্যবস্থাপনা দূর না হলে তখনো বিদেশিরা আসতে চাইবেন না।