
অচিন্ত্য ও কণিকা রুদ্র দম্পতি ঘরের সংকীর্ণ বারান্দায় মুখোমুখি বসে গল্প করতে করতেই বানিয়ে নিচ্ছেন হরেক রকম জিনিস। মাটির ছোট একটি দলাকে হাতের জাদুতে মুহূর্তেই রূপ দিচ্ছিলেন গরু, হাতি, পাখির বাসা, খেলনা আরও কত কিছুতে। হাতের কাজ দেখে মুগ্ধ হতেই হবে।
অচিন্ত্য ও কণিকা রুদ্র দম্পতি থাকেন চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার সাধনপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ সাধনপুর রুদ্র পাড়ায়। এ গ্রামের মৃৎশিল্পীরা এখনো বাপ-দাদার আদি পেশা ধরে রেখেছেন। খুব বেশি লাভজনক না হলেও মাটির নেশা ছাড়তে পারেননি তাঁরা। তাঁদের হাতের ইশারায় মাটির দলা রূপ নেয় শিল্পে।
অচিন্ত্য আর কণিকার সাংসারিক গল্পের ফাঁকে জানতে চাই তাঁদের পেশা সম্পর্কে। অচিন্ত্য রুদ্র বলেন, ‘এটা আমাদের পৈতৃক পেশা। আমাদের আদিপুরুষ এ পেশায় জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। আমরাও এটা ছাড়তে পারছি না। আমি এর বাইরে বাবুর্চির কাজ জানি। কৃষিকাজও করেছি। কিন্তু মাটির কাজই ভালো লাগে। এসব করে তিন সন্তানকে পড়াশোনা করাচ্ছি।’
অচিন্ত্যের স্ত্রী কণিকা কক্সবাজারের ঈদগাঁ এলাকার মেয়ে। বিয়ের পর ভেবেছিলেন, এ কাজ তিনি পারবেন না। কিন্তু এখন এটি এমন আয়ত্ত হয়ে গেছে যে না দেখেও মাটির জিনিস বানাতে পারেন। মুহূর্তেই মাটিকে যেকোনো আকার দিতে পারেন।
কণিকা বলেন, ‘আমরা স্বামী-স্ত্রী একে অপরের সঙ্গে বুদ্ধি–পরামর্শ করে মাটির তৈরি জিনিসপত্র বানাই। মাটির কাজে একধরনের টান আছে। ভালোবাসা বা মমতা না থাকলে আপনি কোনো কাজে সফল হবেন না। কাজকে ভালোবাসতে হবে, মূল্য দিতে হবে।’
গত শনিবার দুপুরে রুদ্রপাড়ায় পৌঁছালে দেখা যায়, পুরো পাড়ার সবাই মাটির তৈরি জিনিসপত্র তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। দুপুরেও ঘুমের অবসর নেই তাঁদের। প্রায় প্রতিটি বাড়ির আঙিনায় স্তূপ করে রাখা হয়েছে মাটির তৈরি জিনিসপত্র।
স্থানীয় লোকজন জানান, মাটির তৈরি শিল্পকর্মের মধ্যে প্রায় ৯০ ধরনের পণ্য তৈরি হয়। তার মধ্যে হাঁড়িপাতিল তৈরি সহজ হলেও ছোট খেলনা ও বাসাবাড়ির শোপিস বানানো অপেক্ষাকৃত কঠিন ও সূক্ষ্ম কাজ। এটিকে স্থানীয় ভাষায় ‘চিকন কাজ’ বলে। সাধনপুরের রুদ্রপাড়ার মৃৎশিল্পীরা এ চিকন কাজই করে থাকেন বছরের পুরোটা সময় ধরে।
এলাকা ঘুরে জানা গেছে, বাঁশখালী উপজেলার বাণী গ্রাম ইউনিয়নের সাধনপুর এলাকা ছাড়াও উপজেলার কালীপুর, আনন্দ বাজার, উত্তর চাম্বল ও দক্ষিণ চাম্বল এলাকায় মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িত আছেন অনেকে। এসব এলাকায় মৃৎশিল্পীরা তৈরি করেন বিভিন্ন আকারের হাঁড়িপাতিল, থালা, বাটি, জগ, সানকি, কলসি, পুতুল, প্রতিকৃতি, ফুলের টব, মাটির ব্যাংক, শোপিস, মটকা, দইয়ের হাঁড়ি, মুচির ঘট, মিষ্টির পাতিল, রসের হাঁড়ি, জলকান্দা, ঘটি, বাটি, জালের চাকা, প্রতিমাসহ খেলনা সামগ্রী।
মৃৎশিল্পীরা বলেন, তৈরি করা মালামাল চট্টগ্রাম শহরের ক্রেতারা পাইকারি দামে কিনে নিয়ে যান। অনেক সময় স্থানীয় পাইকারেরাও কিনে নেন। একবার চুল্লিতে মালামাল পোড়াতে সময় লাগে প্রায় ২০ দিন। এতে ৮-১০ হাজার টাকার জিনিস পাওয়া যায়।
গত ২৯ ডিসেম্বর শিল্প মন্ত্রণালয় পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলায় আয়োজন করে চার দিনব্যাপী বাউফল মৃৎশিল্প ক্লাস্টারের। এতে অংশ নিয়ে অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন অজিত রুদ্র। তিনি বলেন, ‘আমাদের এলাকায় দোআঁশ মাটির কারণে কাজ করা কঠিন। তবে এঁটেল মাটি দিয়ে কাজ তোলা সহজ।’
অজিত আরও বলেন, ‘আমি ৩০ বছর ধরে এ পেশায় জড়িত। পূজার ঘট, বিয়ের ঘট, খেজুরের কলস, কলকি, বাতি, টব, জগ, মগ, চায়ের কাপ, বাটি, কলমদানি, ফুলদানি, ফুট স্ক্রাবার, কয়েলদানি, হাঁড়ি, টব ইত্যাদি তৈরি করি। এ কাজে আমাকে আমার স্ত্রী কৃষ্ণা রুদ্র সহায়তা করেন।’
পাড়ার আরেক মৃৎশিল্পী সন্তোষ রুদ্র দুই ছেলেকে পড়াশোনা করাচ্ছেন মাটির কাজের আয় দিয়ে। তিনি বলেন, ‘বাবার মৃত্যুর পর ১৫ বছর ধরে মাটির কাজ করছি। আমার বাবা নগরবাসী রুদ্রও এ কাজ করেছেন। সপ্তাহে ছয় হাজার কিস্তি শোধ করেও আমি বছরে ৫০-৬০ হাজার টাকা লাভ করি।’
তবে পাড়ার সনজিত রুদ্র, ক্ষেত্রমোহন রুদ্র, ঝিনু রুদ্র ও সভারানী রুদ্রদের কথায় একটু আফসোসও ছিল। মাটির জিনিসের আগের সেই রমরমা ব্যবসা এখন আর নেই। ব্যয় ও পরিশ্রম হিসেবে ধরলে আয় কম। পাশাপাশি প্লাস্টিক, স্টিল, মেলামাইন, সিরামিক ও অ্যালুমিনিয়ামের জিনিসের কারণে মাটির জিনিসের কদর নেই। তারপরও ভালোবাসার টানেই এই পেশায় আছেন বলে জানালেন তাঁরা।
সাধনপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কে এম সালাউদ্দিন কামাল বলেন, ‘আমাদের রুদ্রপাড়ার মৃৎশিল্পীদের কাজের সুনাম পুরো জেলায় ছড়িয়ে আছে। তাঁরা শুধু আদি পেশাটাই ধরে রাখেননি, এলাকার সুনামও বয়ে আনছেন।’