বিগত তিন দশকে মাগুরায় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে মূল প্রতিযোগিতা হয়েছে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ (কার্যক্রম নিষিদ্ধ) মাঠে না থাকলেও স্বস্তিতে নেই বিএনপি। দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধের কারণে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন দলীয় প্রার্থীরা।
মাগুরার দুটি সংসদীয় আসনে ইতিমধ্যে প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিএনপি। প্রতিটিতেই প্রার্থী নিয়ে দলের একাংশের নেতা-কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। অন্যদিকে দুটি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করে প্রচার চালাচ্ছে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। নির্বাচন সামনে রেখে তৎপরতা শুরু করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণ অধিকার পরিষদ, গণফোরাম, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) ও জাতীয় পার্টি (জাপা)।
বিএনপিতে অসন্তোষ
দীর্ঘদিন ধরে মাগুরার বিএনপি দুটি ধারায় বিভক্ত। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর এক পক্ষের নেতৃত্বে ছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান নিতাই রায় চৌধুরী ও জেলা বিএনপির সদস্যসচিব মনোয়ার হোসেন খান। মাগুরা-১ (সদর-শ্রীপুর) আসনে মনোয়ার হোসেনকে ও মাগুরা-২ (শালিখা-মহম্মদপুর) আসনে নিতাই রায় চৌধুরীকে মনোনয়ন দিয়েছে বিএনপি। অন্য পক্ষে নেতৃত্ব দিতে দেখা গেছে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আলী আহমেদ, সাবেক সংসদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য কাজী সালিমুল হক (কাজী কামাল) এবং ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের সদস্যসচিব রবিউল ইসলামকে (নয়ন)। এর মধ্যে আলী আহমেদ মাগুরা-১ এবং কাজী সালিমুল হক ও রবিউল ইসলাম মাগুরা-২ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন।
মাগুরা-১ আসনে প্রাথমিকভাবে মনোনয়ন পাওয়ার পর গত ৫ নভেম্বর মনোয়ার হোসেন খানকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ওই দিন ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে ব্যাপক শোডাউন দেন তাঁর অনুসারীরা। তবে সেখানে মনোনয়নবঞ্চিত আলী আহমেদসহ একটি অংশের নেতা-কর্মীদের দেখা যায়নি। পরে প্রার্থী পরিবর্তনের জন্য ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে দলের মহাসচিবের মাধ্যমে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করেছে একটি অংশ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলা বিএনপির একজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই আবেদনে সমর্থন জানিয়ে আমরা ২২ হাজার নেতা-কর্মী স্বাক্ষর করেছি। আমরা কেন্দ্রকে এটা জানিয়ে রাখলাম যে ভুল ব্যক্তিকে এখানে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে এটা প্রমাণিত হবে।’
অবশ্য মনোনয়ন পাওয়া মনোয়ার হোসেন খান দাবি করেন, নেতা-কর্মীদের কোনো বিরোধ নেই, যেটা আছে সেটা প্রতিযোগিতা। তিনি বলেন, ‘বিএনপির বেশির ভাগ নেতা-কর্মী আমার সঙ্গে সক্রিয় আছেন। কিছু নেতা ব্যক্তিগত ব্যস্ততার কারণে সময় দিতে পারছেন না। তবে ভোটের সময় এগিয়ে এলে সব ঠিক হয়ে যাবে।’
দলীয় মনোনয়ন না পাওয়া জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আলী আহমেদ বলেন, এখানে যেহেতু একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন, ফলে সমর্থকদের মধ্যে অসন্তোষ থাকতে পারে। প্রার্থীর এখানে দায়িত্ব হচ্ছে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে মাঠে কাজ করা।
অন্যদিকে মাগুরা-২ আসনে মনোনয়ন পাওয়া নিতাই রায় চৌধুরীকে নিয়ে দলের একটি অংশের অসন্তোষ রয়েছে। এ কারণে দলের আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী কাজী সালিমুল হকের পক্ষে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করে নেতা-কর্মীদের একটি অংশ। তবে তিনি গত শনিবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করার পাশাপাশি সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসরের ঘোষণা দেন। আসনটিতে আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী রবিউল ইসলাম বলেন, ‘আমিও প্রার্থী ছিলাম। এখন ধানের শীষ যাঁকে দেওয়া হয়েছে, আমি তাঁর জন্যই কাজ করব। প্রার্থীর সঙ্গে আমার ইতিমধ্যে কথা হয়েছে।’
এ বিষয়ে নিতাই রায় চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আপনি দল করলে দলের নির্দেশনা মানতে হবে। আশা করি ভোটের আগে সবাই ধানের শীষের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাঠে থাকবেন।’
সুযোগ দেখছে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন
১৯৯৬ সালের পর মাগুরায় জাতীয় নির্বাচনে জামায়াতের প্রার্থীদের অংশ নিতে দেখা যায়নি। তবে এবার তাঁরা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। মাগুরা-১ আসনে জেলা জামায়াতের সাবেক আমির আবদুল মতিন ও মাগুরা-২ আসনে কেন্দ্রীয় শুরা সদস্য এম বি বাকের মনোনয়ন পেয়েছেন। এক বছরের বেশি সময় ধরে তাঁরা নির্বাচনী এলাকায় সক্রিয়।
এম বি বাকের প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে আমাদের যে পরিমাণ ভোটার ছিল, এখন কর্মিসংখ্যা তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। প্রতিটি ইউনিয়ন, ওয়ার্ড ও গ্রামে আমাদের কমিটি আছে। এ ছাড়া বর্তমান পরিস্থিতির নানা কারণে আমরা জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী।’
মাগুরায় সর্বশেষ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিভিন্ন এলাকায় উল্লেখযোগ্য ভোট পেয়েছিলেন ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থীরা। এবার তাঁরা ভালো ফলের প্রত্যাশা করছেন। বিশেষ করে জামায়াতসহ আটটি দলের জোট হলে জয়ের ব্যাপারে তাঁরা আত্মবিশ্বাসী।
ইসলামী আন্দোলনের জেলা সভাপতি ও মাগুরা-২ আসনের প্রার্থী মুফতি মোস্তফা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের জোট হলে ভাসমান ভোটের একটা বড় অংশ আমাদের পক্ষে আসবে। এ ছাড়া বিএনপির মতবিরোধের কারণে তাদের একটা অংশের ভোটও আমাদের পক্ষে আসতে পারে।’
অন্যদের কী অবস্থা
এনসিপির পক্ষ থেকে মাগুরা-২ আসনে খাজা মো. তরিকুল ইসলামকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। তবে তাঁদের তৎপরতা এখনো সীমিত। একই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রচার চালিয়ে আসছিলেন আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়ার সাবেক একান্ত সচিব মো. মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি এখনো মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেননি।
নির্বাচন সামনে রেখে তৎপরতা শুরু করেছে জাপা। ইতিমধ্যে দুটি আসনে দুজনকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন দলটির জেলার জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সিরাজুস সাইফিন। মাগুরা-১ আসনে প্রার্থী হয়েছেন বাসদের জেলার আহ্বায়ক শম্পা বসু। এ ছাড়া মাগুরা-১ আসনে নির্বাচন করার কথা জানিয়েছেন গণফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান। অন্যদিকে একই আসন থেকে এবার মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন ২০২৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাকিব আল হাসানের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশ কংগ্রেসের চেয়ারম্যান কাজী রেজাউল হোসেন।
মাগুরা-১ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন কিনে আলোচনার জন্ম দিয়েছেন শ্রীপুর উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি কুতুবুল্লাহ হোসেন মিয়া। শ্রীকোল ইউপির এই চেয়ারম্যান অবশ্য মনোনয়নপত্র কেনার দিনই পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাঁর ভাই সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শরিয়তউল্লাহ হোসেন মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সব সময়ই স্বতন্ত্র। মনোনয়ন বৈধ হলে আমাদের ভোটের প্রস্তুতি রয়েছে।’