দিনাজপুর সদর উপজেলায় কর্ণাই হাজীপাড়া গ্রামে ইয়াছিন আলী রাকিব চাষ করছেন বিভিন্ন প্রজাতির রঙিন মাছ। গত সোমবার দুপুরে তোলা
দিনাজপুর সদর উপজেলায় কর্ণাই হাজীপাড়া গ্রামে ইয়াছিন আলী রাকিব চাষ করছেন বিভিন্ন প্রজাতির রঙিন মাছ। গত সোমবার দুপুরে তোলা

রাকিবের রঙিন মাছের খামার, মাসে আয় ৪৫ হাজার টাকা

দিনাজপুর সদর উপজেলার কর্ণাই হাজীপাড়া গ্রামের তরুণ ইয়াছিন আলী রাকিব (২৫)। বাড়ির উঠানে তিনি তৈরি করেছেন রঙিন মাছের খামার। সিমেন্ট, মাটি, পলিথিন ও বাঁশ দিয়ে বানানো ৪৫টি চৌবাচ্চায় স্বচ্ছ পানিতে খেলা করছে গাপ্পি, গোল্ডফিশ, জেব্রা, কইকাপ, টাইগার বার্পসহ ১৮ প্রজাতির শৌখিন মাছ।

বিশেষ কৌশলে মাছের জন্য অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়। নিয়মিত খাবার দেওয়া হয়। মাছ বড় হচ্ছে, বাচ্চাও দিচ্ছে। এই মাছ দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় শৌখিন মাছপ্রেমীদের কাছে বিক্রি করে রাকিব প্রতি মাসে আয় করছেন ৪০-৪৫ হাজার টাকা। সংসারের খরচ চালানোর পাশাপাশি তুলেছেন পাকা বাড়ি, কিনেছেন মোটরসাইকেল।

রাকিবের উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প শুরু করোনাকালে। ইউটিউবে রঙিন মাছ চাষের ভিডিও দেখে আগ্রহী হয়ে ৩৬০ টাকায় গাপ্পি প্রজাতির ছয়টি মাছ কেনেন। বাড়ির উঠোনে চৌবাচ্চা বানিয়ে তাতে মাছ ছাড়েন। কয়েক দিনের মধ্যে মাছ বাচ্চা দেয়। আনন্দ আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে গরু বিক্রি করে নতুন প্রজাতির মাছ যোগ করেন খামারে। ধীরে ধীরে দেশের বিভিন্ন জেলার শৌখিন মাছচাষিদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ে।

দিনাজপুরে প্রথমবারের মতো ছোট হাউসে শৌখিন মাছের খামার করেছেন রাকিব। আমরা তাঁকে প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তা দিচ্ছি।
শারমিন আক্তার, উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা, দিনাজপুর সদর

২০২১ সালে বাবা মারা গেলে সংসারের ব্যয় মেটাতে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে চাকরি নেন রাকিব। দিনে ১২ ঘণ্টার বেশি কাজের চাপ সামলে খামারের দেখাশোনা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই সেই বছরই চাকরি ছেড়ে দেন। রাকিব বলেন, ‘চাকরি ছেড়ে পুরোদস্তুর খামারি হয়ে গেলাম। নিজের ফেসবুক আইডিতে (ইয়াছিন অ্যাকোয়া ফার্ম) খামারের ভিডিও দিতাম। এখন ফলোয়ার ১০ হাজারের বেশি। ক্রেতাদের বেশির ভাগই ফেসবুকের মাধ্যমে পাই।’

খামারের ব্যস্ততা ও বিক্রির ধরন

সোমবার রাকিবের খামারে গিয়ে দেখা যায়, তিনি মাছকে ক্ষুদ্র দানাদার ফিড খাওয়াচ্ছেন, তাদের সঙ্গে কথা বলছেন। ৯ শতাংশ জমির মধ্যে ৫ শতাংশে খামার গড়ে তুলেছেন। প্রতিদিন ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অর্ডার নেওয়া, মাছ প্রস্তুত করা ও গ্রাহকের কাছে পাঠাতে সময় চলে যায়। সকালে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৩০০টি মাছ পাঠান তিনি, দাম পান সাড়ে সাত হাজার টাকা। দুপুরে ঠাকুরগাঁওয়ের এক গ্রাহকের জন্য ১৫০টি মাছ প্রস্তুত করেন।

শীতের শুরুর সময় মাছ ডিম ও বাচ্চা দেয়। কোন প্রজাতির মাছের কী বৈশিষ্ট্য, তা এখন রাকিব ভালোভাবেই আয়ত্ত করেছেন।

মাছ বিশেষ পলিব্যাগে ভরে মিথাইল মিশ্রিত পানি ও অক্সিজেন দিয়ে প্যাকেট করেন। ব্যাগে গ্রাহকের ঠিকানা লিখে পরিবহনে করে পাঠানো হয়। টাকা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আগে নিয়েই সরবরাহ দেন।

সিমেন্ট, মাটি, পলিথিন ও বাঁশ দিয়ে বানানো ৪৫টি চৌবাচ্চায় স্বচ্ছ পানিতে খেলা করছে গাপ্পি, গোল্ডফিশ, জেব্রা, কইকাপ, টাইগার বার্পসহ ১৮ প্রজাতির শৌখিন মাছ

রাকিব এখন ১৩-১৫ লাখ টাকার মাছ ও উপকরণের মালিক। পাশাপাশি ১০টি ছাগল ও ২টি গরুর ছোট খামারও গড়ে তুলেছেন। স্ত্রী অনন্যা হক খামারে তাঁকে সহযোগিতা করেন। দুজন কর্মচারীও রেখেছেন মাসে ৮ হাজার টাকা বেতনে। রাকিব বলেন, ‘৩৬০ টাকার পুঁজি থেকে এখন খামারে লাখ লাখ টাকার সম্পদ। তবে জায়গার অভাবে খামার বড় করতে পারছি না।’

শীতের শুরুর সময় মাছ ডিম ও বাচ্চা দেয়। কোন প্রজাতির মাছের কী বৈশিষ্ট্য, তা এখন রাকিব ভালোভাবেই আয়ত্ত করেছেন। বড় মাছগুলো অন্যের পুকুরে রাখেন, মৌসুম এলে খামারে নিয়ে আসেন। তিনি বলেন, ‘শিশুরা এখন মোবাইলে ব্যস্ত। বাড়িতে অ্যাকুয়ারিয়ামে শৌখিন মাছ থাকলে ওরা প্রাণীদের সঙ্গে সময় কাটাতে পারবে।’

দিনাজপুর সদর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা শারমিন আক্তার বলেন, ‘দিনাজপুরে প্রথমবারের মতো ছোট হাউসে শৌখিন মাছের খামার করেছেন রাকিব। আমরা তাঁকে প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তা দিচ্ছি। শহরের অনেক বাড়িতে এখন অ্যাকুয়ারিয়াম রাখা হচ্ছে। এতে রাকিবের উৎসাহ ও খামারের স্থায়িত্ব দুটিই বাড়বে। খামার বড় করতে চাইলে স্বল্প সুদে ব্যাংকঋণ পেতেও সহযোগিতা করব।’