
বর্ষাকালে এক-দুবার বন্যার পানিতে ঘরবাড়ি তলিয়ে যাওয়া অনেকটা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সময় মৌলভীবাজার সদর উপজেলার খলিলপুর ইউনিয়নের চার-পাঁচটি গ্রামের মানুষ মানসিকভাবে বন্যার প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন। কুশিয়ারা নদীর পাড় ছাপিয়ে শুধু ঘরবাড়ি তলিয়ে যায় না; ডুবে যায় মাঠের ফসল, চলাচলের অনুপযোগী হয় গ্রামের রাস্তাঘাট। কয়েক বছর ধরেই এমন ভোগান্তি গ্রামবাসীর জীবনযাপনের অংশ হয়ে গেছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, দীর্ঘদিনেও সেখানে স্থায়ী কোনো প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মিত হয়নি। স্থায়ী ও উঁচু বাঁধ না থাকায় বছরে একাধিকবার বন্যার পানিতে ভোগান্তি পোহাতে হয় হাজারো গ্রামবাসীকে। গত বর্ষাকালে অন্তত তিনবার কুশিয়ারা নদীর পানি ঢুকে গ্রামগুলোতে প্লাবিত হয়েছে। ঘর ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠতে হয় অনেক পরিবারকে। কুশিয়ারা নদীর পানি ঢুকলে টানা দুই থেকে আড়াই মাস পানি থাকে। জলাবদ্ধতায় অনেকের উঠানে বাঁশের সাঁকো তৈরি করে ঘর থেকে বের হতে হয়। অনেক পরিবারকে আশ্রয়কেন্দ্রে দীর্ঘ সময় কাটাতে হয়। প্রতিবছর বন্যায় মুক্তিনগর, ব্রাহ্মণগ্রাম, হামরকোনা, দাউদপুরসহ কয়েকটি গ্রামের প্রায় এক হাজার পরিবার বন্যাকবলিত হচ্ছে। এ ছাড়া গ্রামের শেরপুর-হামরকোনা সড়ক, আফরোজগঞ্জ ও শেরপুর বাজার এবং স্থানীয় আজাদ বখত উচ্চবিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজ এলাকাও বছর বছর প্লাবিত হচ্ছে।
গত ২৫ জানুয়ারি সদর উপজেলার খলিলপুর ইউনিয়নের শেরপুরে কুশিয়ারা নদীর পারের গ্রামগুলো ঘুরে দেখা গেছে, কুশিয়ারা নদীর পানি এখন অনেক নিচে। ধীরে ও শান্ত বেগে নদীর পানি প্রবাহিত হচ্ছে। কিন্তু একটি বাঁধ না থাকায় বর্ষাকালে এই নদী পাড়ের মানুষের কাছে আতঙ্কের কারণ হয়ে ওঠে। গত বছরের বন্যার অনেক দিন পরও নদীর পাড়, গ্রামের ভেতরের কাঁচা-পাকা সড়ক, বিভিন্ন ঘর ও স্থাপনায় ক্ষতচিহ্ন আছে। শেরপুর ফেরিঘাটের দিক থেকে নদীর পাড় ধরে চলার সময় দেখা গেছে, ব্রাহ্মণগ্রামে পাড় ঘেঁষে অনেকের কাঁচা-পাকা ঘরবাড়ি। পাড়েই গ্রামের চলাচলের পথ তৈরি হয়েছে। পথের কিছু স্থানে বর্ষায় পানির উচ্চতা ঠেকানোর জন্য বালুর যেসব বস্তা ফেলা হয়েছিল, তা এখনো আছে। ব্রাহ্মণগ্রামের কয়েকটি স্থানে নদীর পাড়ের ঢালুতে ধস দেখা দিয়েছে। পাড় ঘেঁষে তৈরি হয়েছে দীর্ঘ ফাটল। গ্রামবাসীর আশঙ্কা, আগামী বর্ষা মৌসুমে এ ফাটলগুলোর স্থানে ভাঙন শুরু হলে আশপাশের বাড়ি, ফসলি মাঠ ও অন্য স্থাপনা ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।
স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা জানান, সড়কের ওপর দিয়ে উপচে পড়া পানি ঠেকাতে গত বছর গ্রামবাসী স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে বাঁশের বেড়া দিয়ে বাঁধ দেন এবং বালুর বস্তা ফেলেন। কিন্তু পানি আটকানো সম্ভব হয়নি। পানির তোড়ে সব প্রতিরোধ ভেঙে গ্রাম প্লাবিত হয়। একটি স্থানে পানির স্রোতে রাস্তা ভেঙে খালের মতো তৈরি হয়েছে। সেখানে বাঁশের সেতু নির্মাণ করে পায়ে চলার ব্যবস্থা করেছেন তাঁরা।
ব্রাহ্মণগ্রামের নুরুন্নেছা বলেন, ‘একবার-দুইবার না, পত্তেক বছর বান (বাঁধ) ভাঙি বন্যার পানি ঘরও ওঠে।’ হামরকোনা গ্রামের আবদুর রহিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিবারই বন্যা অয় (হয়)। এবার (গত বর্ষায়) তিনবার বন্যা অইছে। স্থায়ী বান নাই, কুশিয়ারার পানি ঠেলার লগে গ্রামের ভেতর ঢুকি যায়। কুশিয়ারার ডাইক (বাঁধ) থাকলে পানি ঢুকল নানে (ঢুকত না)।’ একই গ্রামের আবদুল আহাদ বলেন, ‘এবার (গেল বর্ষায়) তিনবার খেত লাগাইছি (ফসলের মাঠে ধানের চারা রোপণ করা হয়েছে)। শেষে ছিড়া-পাকলা কিছু অইছে (মোটামুটি কিছু ধান হয়েছে)। কুশিয়ারায় ডাইক (বাঁধ) না অইলে (হলে) শান্তি অইতো নায় (হবে না)।’
কুশিয়ারা পাড়ে বাঁধ নির্মাণকেই এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান হিসেবে উল্লেখ করেন খলিলপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবু মিয়া চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘১৯৮৮ সাল থেকে এ ডাইক (বাঁধ) নির্মাণের কথা বলে আসছি। আমি তখন ইউপি সদস্য ছিলাম। ডাইক নির্মাণের দাবি এখন স্লোগান হয়ে গেছে, তবে এখনো নির্মিত হয়নি। এবার ইউনিয়ন পরিষদের বরাদ্দ থেকে কুশিয়ারাপাড়ের রাস্তাটি কিছুটা উঁচু করতে চাইছি, যাতে পানি বাড়লেও সহজে ঢুকতে না পারে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) মৌলভীবাজার কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী খালেদ বিন অলীদ প্রথম আলোকে বলেন, কুশিয়ারার ওই স্থানে (শেরপুর এলাকা) বাঁধ নেই। কুশিয়ারা নদীর মৌলভীবাজার, সিলেট ও হবিগঞ্জ অংশ নিয়ে সমীক্ষা চলমান। সমীক্ষা শেষে প্রকল্প নেওয়া হবে। এই প্রকল্পে ওই স্থানও যুক্ত হবে।