একসঙ্গে মা-বাবা হারানো অবুঝ নাতি–নাতনিদের নিয়ে হতবিহ্বল আছিয়া

সূর্যল হক ও জেসমিন আক্তারের তিন সন্তানের সঙ্গে তাঁদের নানি আছিয়া খাতুন। আজ শুক্রবার সকালে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার গাদিশাল গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

অভাব-অনটনের কারণে সংসারে সব সময়ই কলহ লেগে থাকত। এ রাগ-ক্ষোভ থেকেই স্ত্রী ও প্রতিবন্ধী সন্তানকে হত্যা করে সূর্যল হক নিজেও আত্মহত্যা করেন বলে ধারণা করছেন স্বজন, প্রতিবেশী ও তদন্তে নিয়োজিত পুলিশ কর্মকর্তারা।

সূর্যল হকের বাড়ি হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার গাদিশাল গ্রামে। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে পুলিশ বাড়ির পাশে গাছ থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় সূর্যল হকের (৪৫) লাশ উদ্ধার করে। এরপর শোবার ঘরের খাটের নিচে স্ত্রী জেসমিন আক্তার (৩৫) ও খাটের ওপর প্রতিবন্ধী ছেলে ইয়াসিনের (১০) লাশ পাওয়া যায়। আজ শুক্রবার হবিগঞ্জের ২৫০ শয্যার জেলা হাসপাতালে এই তিন লাশের ময়নাতদন্ত হয়।

এই দম্পতির চার সন্তান। মা-বাবার সঙ্গে মৃত্যু হয় বড় ছেলে ইয়াসিনের। অন্য তিন সন্তান হলো দিহান (৮), শিরিন (৪) ও আইরিন (২)।

আজ শুক্রবার সকালে চুনারুঘাটের গাদিশাল গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, মৃত সূর্যল হকের বাড়িতে স্বজনদের ভিড়। সবাই পরিবারটির খোঁজখবর নিতে এসেছেন। সূর্যল হকের শাশুড়ি আছিয়া খাতুন অবুঝ তিন নাতি-নাতিনকে নিয়ে উঠানে বসে আছেন।

বাবা–মার কথা মনে হলেই কাঁদছে অবুঝ তিন ভাই–বোন

গতকাল বিকেলে খবর পেয়ে ছুটে আসেন আছিয়া খাতুন। তিনি বলেন, মা-বাবার কথা মনে হলেই শিশুরা কেবল কান্না করে। পাশের ঘরের শিশুদের এক চাচি সকালের খাবার খাইয়েছেন। মা-বাবাহারা এই শিশুদের নিয়ে এখন তিনি কী করবেন, তা ভেবে পাচ্ছেন না।

গাদিশাল গ্রামের লোকজন জানান, গতকাল বিকেলে ওই গ্রামের ১৩ বছরের এক শিশু ছাগল আনতে মাঠে যায়। এ সময় সূর্যল হকের ঝুলন্ত লাশ দেখতে পেয়ে সে চিৎকার করে সবাইকে জানায়। খবর পেয়ে পুলিশ বিকেল সাড়ে পাঁচটায় ঘটনাস্থলে গিয়ে একে একে তিনজনের লাশ উদ্ধার করে।

প্রতিবেশীরা জানান, ঘটনার সময় আইরিন ও ইয়াসিন মা-বাবার সঙ্গে বাড়িতেই ছিল। আর দুজন বাড়ির বাইরে খেলতে গিয়েছিল। আইরিনের খালা রিনা আক্তার বলেন, আইরিনকেও তাঁর বাবা গলায় দড়ি পেঁচিয়ে হত্যার চেষ্টা করেন। গলায় আঘাতের চিহ্ন ও আইরিনের কথায় তাঁরা বিষয়টি জানতে পেরেছেন। তবে শিশুটি কীভাবে বেঁচে গেল, কেউ তা আঁচ করতে পারছেন না। কারও কারও ধারণা, শিশুটি মরে গেছে ভেবে সূর্যল তাকে ঘরে রেখে চলে যায়।

সূর্যল হকের ঘরের পাশেই বসবাস করেন তাঁর ভাই নুরুল হক (৫০)। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ভাই বাঁশের ঝুড়ি তৈরি করে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করতেন। পাশাপাশি তাঁর স্ত্রী জেসমিন আক্তার প্রতিবন্ধী ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করতেন। এভাবেই তাঁদের সংসার চলত। অভাবের কারণে প্রায় সময়ই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া লেগে থাকত। ঘটনার দিন তিনি কাজে বাইরে ছিলেন। তাঁর স্ত্রীও ঘরের বাইরে ছিলেন। নুরুল হক বলেন, ভাই নেই। তাঁর রেখে যাওয়া তিন শিশুকে তিনিই দেখাশোনা করবেন।

স্থানীয় আহম্মদাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাকির হোসেন বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে আমরা ধারণা করছি, সংসারের অভাব-অনটন থেকেই পারিবারিক কলহের জেরে এ ঘটনা ঘটেছে। ঘটনার সময় নিহত দম্পতির অন্য তিন সন্তান খেলা করতে বাইরে গিয়েছিল। বাড়িতে থাকলে তারাও হয়তো দুর্ঘটনার শিকার হতো।’

চুনারুঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রাশেদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, প্রাথমিকভাবে তাঁরা ধারণা করছেন, সংসারের অভাব-অনটন থেকে পারিবারিক কলহের জেরে স্ত্রী-সন্তানকে হত্যার পর ওই ব্যক্তি আত্মহত্যা করেছেন। এ ঘটনায় তদন্ত চলছে। বিভিন্ন সংস্থা তদন্ত করছে। আজ শুক্রবার নিহত ব্যক্তিদের লাশের ময়নাতদন্ত হবিগঞ্জের ২৫০ শয্যার জেলা সদর হাসপাতালে সম্পন্ন হয়। এখনো মামলা হয়নি। তবে মামলার প্রস্তুতি চলছে।