রংপুরের তারাগঞ্জ বাজারে জুতা সেলাইয়ের কাজ করছে পিটিয়ে হত্যা করা রূপলালের ছেলে জয় দাস।
রংপুরের তারাগঞ্জ বাজারে জুতা সেলাইয়ের কাজ করছে পিটিয়ে হত্যা করা রূপলালের ছেলে জয় দাস।

দুজনকে পিটিয়ে হত্যা

সংসার চালাতে বই ছেড়ে জুতা সেলাইয়ে রূপলালের কিশোর ছেলে

ভোরের আলো ফোটার পর থেকে রংপুরের তারাগঞ্জ বাজার জমতে থাকে। ফল-সবজির গন্ধ, গরু-ছাগল ও মাছ বিক্রেতার হাঁকডাক আর পথচারীর ভিড়ে চোখে পড়ে অন্য রকম এক দৃশ্য। জমজমাট বাজারের ফুটপাতে ছোট্ট কাঠের চৌকিতে বসে আছে এক কিশোর। সুইয়ে সুতা গেঁথে জুতার ফাটা অংশে টান দিচ্ছে বারবার। বয়স মাত্র ১৪, কিন্তু এই বয়সেই জীবনের নিষ্ঠুরতা খুব কাছ থেকে দেখেছে সে।

চৌকিটা একসময় ছিল রূপলাল রবিদাসের। পেশায় তিনি ছিলেন জুতা সেলাইকারী। এই কাজ করে সংসার চালাতেন তিনি। গত ৯ আগস্ট রাতে ভ্যানচোর সন্দেহে তাঁকেসহ দুজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। সেই থেকেই সংসারের হাল ধরার দায়িত্ব এসে পেড়েছে নবম শ্রেণির ছাত্র জয় রবিদাসের ওপর। বই-খাতার বদলে তার সামনে এখন হাতুড়ি, সুতা আর পালিশের কৌটা।

জয়ের বাড়ি রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ঘনিরামপুর গ্রামে। সে তারাগঞ্জ সরকারি মডেল উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র। স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার। বাবাকে হারিয়ে সেই স্বপ্ন থেমে গেছে তার।

জয় জানায়, সকাল ১০টায় দোকান খুলে বিকেল ৫টা পর্যন্ত জুতা সেলাই, জুতা রং কাজ করলে ৩০০ টাকার মতো আয় হয়। জুতা বানাতে পারলে আয় আরও বাড়বে। তবে ৩০০ টাকায় কুলায় না। মা, দুই বোন, দাদিসহ তাঁদের পাঁচজনের সংসার এই টাকায় চালাতে টানাটানি হয়।

সুই গেঁথে জুতায় ফোঁড় দিতে দিতে জয় বলে, ‘বাবা কত কষ্ট করত, এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। যখন যেটা চাইছি, কখনো বাবা না করে নাই। এখানে বসে থাকতে কোমর লেগে যায়, পা অবশ হয়ে আসে। বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো এই কষ্ট হতো না। আমি স্কুলে গিয়ে পড়ালেখা করতাম। বাবার স্বপ্ন ছিল আমাকে শিক্ষক দেখার। কিন্তু আমি এখন সুই হাতে জুতা সেলাই করছি। উপায় নেই, সংসারের একমাত্র উপার্জনকারী ছিলেন বাবা। এখন মা, ঠাকুরমা আর দুই বোনকে নিয়ে সংসার চালাতে হবে আমাকে। আমার পড়াশোনা হবে কি না জানি না, তবে দুই বোনকে পড়াতে চাই। পরিবারকে সুখে রাখতে চাই।’

তারাগঞ্জ-কিশোরগঞ্জ সড়কের ধারে স্থানীয় ব্যবসায়ী মেহেদী হাসান বলেন, এক যুগের বেশি সময় ধরে রূপলাল তাঁর দোকানের সামনে ছোট কাঠের চৌকিতে বসে জুতা সেলাইয়ের কাজ করতেন। খুব বিনয়ী মানুষ ছিলেন। রূপলাল গল্প করতেন ছেলে লেখাপড়ায় ভালো, পড়ালেখা শেষ করে ভালো একটা চাকরি পেলে তাঁর কষ্ট দূর হবে। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর ছেলে এখন সেই জায়গায় জুতা সেলাই করছে।

জয়দের বাড়িতে গিয়ে দেখা হয় তার মা ভারতী রানীর সঙ্গে। স্বামীকে হারিয়ে সংসার চালাতে যে তাঁর অনেক কষ্ট হয়, কথাতে সেটাই ফুটে উঠল। বললেন, ‘ছোট মেয়ে রুপাক ভাত দিলে মাছ চায়। দিবার না পায়া মারছি। কান্না করতে করতে ভাত না খাইয়া ঘুমাইছে। জাগলে তো ফির বায়না ধরবে। কিন্তু ওক মাছ দিব কোনঠে থাকি। ঘরোত খাবার নাই, আমার চিকিৎসা করার টাকা নাই। বেটির বিয়ার খরচপাতি নিয়া খুব দুশ্চিন্তায় আছি। দুধের ছেলেটা স্কুল বাদ দিয়া জুতা সেলাই করোছে। আমার বুকটা ফাটি যাওছে।’

ভারতীর কথা শেষ না হতেই ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন তাঁর শাশুড়ি লালিচা রানী। বললেন, ‘মোর নাতি–নাতনিরা আজ এতিম। ওমার খাওয়া পরার উপায় নাই। ছোট নাতিন সব সময় ওর বাপের জন্য কান্দে। বড় নাতিন রাতে ঘুমায় না, কান্নাকাটি করে। ইউএনও স্যার আর বিএনপির লোকজন যে টাকা দিছে, বড় নাতিনের বিয়ের জন্য ব্যাংকে থুইছি। এলা তো সংসার চলার উপায় নাই।’

রংপুরের তারাগঞ্জে গণপিটুনির আগে হাত জোড় করে এভাবে বাঁচার আকুতি জানান প্রদীপ লাল (বাঁয়ে)। নিজের পরিচয় বলছিলেন রূপলাল (ডানে)

জয়ের বড় বোন নূপুর রানী বলেন, বাবার মৃত্যুর পর পুরো পরিবারের ভার পড়েছে ছোট জয়ের ওপর। লেখাপড়ার পাশাপাশি যদি জয়ের একটা কাজের ব্যবস্থা হতো, তাহলে ভালো হতো।

জয়ের সহপাঠী মফিজার রহমান বলে, বাবা বেঁচে থাকতে জয়কে কোনো দিন জুতা সেলাই করতে দেখেনি সে। এখন জয় ছাড়া পরিবারে আয় করার মতো কোনো পুরুষ নেই। এ জন্য তাকে কাজে যেতে হচ্ছে। এটা অনেক কষ্টের।

তারাগঞ্জ সরকারি মডেল উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মুসা সরকার বলেন, ‘খুব খারাপ লাগছে জয়কে কাজ করতে দেখে। তার বাবাকে আজ মব সৃষ্টি করে যদি মেরে ফেলা না হতো, তাহলে তাকে ক্লাস ছেড়ে বাজারে জুতা সেলাই করতে হতো না। আমরা তাকে সব ধরনের সহযোগিতা করব, সে যাতে ক্লাস–পরীক্ষায় অংশ নিতে পারে।’

রংপুরের তারাগঞ্জে দুই ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় ছড়িয়ে পড়া তিনটি ভিডিও বিশ্লেষণ করে মারধরে জড়িত অন্তত সাতজনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে

গত ৯ আগস্ট রাতে রূপলাল রবিদাস (৪৮) ও তাঁর ভাগনি জামাই প্রদীপ লাল রবিদাস (৪৭) ব্যাটারিচালিত ভ্যানে বাড়ি ফিরছিলেন। পথে তারাগঞ্জের বুড়িরহাট বটতলায় তাঁদের ভ্যানচোর সন্দেহে আটক করেন স্থানীয় লোকজন। এরপর তাঁদের দুজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পরের দিন রূপলালের স্ত্রী ভারতী রানী তারাগঞ্জ থানায় মামলা করেন। ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে এখন পর্যন্ত ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

তারাগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এম এ ফারুক বলেন, গ্রেপ্তার ছয়জনকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। অন্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকতা (ইউএনও) রুবেল রানা বলেন, রূপলালের পরিবারকে কয়েক দিন আগে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এক লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। আরও সহযোগিতার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।