Thank you for trying Sticky AMP!!

বেলাবতে গুঁড়িয়ে দেওয়া বাদ্যযন্ত্র নিয়ে কাঁদছেন লালনশিল্পীরা

নরসিংদীর বেলাব উপজেলায় সাধুসঙ্গে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা বাদ্যযন্ত্র। মঙ্গলবার উপজেলার পাটুলি ইউনিয়নের ভাবলা গ্রামে

নরসিংদীর বেলাব উপজেলার ভাবলা গ্রামের মাঝ দিয়ে সরু নালার মতো বয়ে গেছে গঙ্গাজলী নদী। নদীর দুই পাশে বিস্তৃত ফসলের মাঠ। নদীর চিন্তামণি ঘাটের পাশেই ৪৩ শতাংশ জমিতে ড্রাগনবাগান করেন লালনভক্ত মো. জাহাঙ্গীর আলম। বাগানের এক কোণে কাঠবাদামগাছের নিচে লালনভক্তদের সাধুসঙ্গ করার স্থান।

গত রোববার দুপুরে ওই বাগানের আশ্রমে সাধুসঙ্গ করতে এসেছিলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ১০ থেকে ১২ জন লালনশিল্পী। তাঁদের ওপর হামলা চালিয়ে অন্তত ২০টি বাদ্যযন্ত্র ভাঙচুর করা হয়। গুঁড়িয়ে দেওয়া বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে ছিল হারমোনিয়াম, তবলা, একতারা, ডুগি, হাতবাড়া, খমক, দোতারা, সারিন্দা, গিটার ও বাঁশি। গুঁড়িয়ে দেওয়া বাদ্যযন্ত্র পাশে নিয়ে কাঁদছেন শিল্পীরা।

ছয় বছর ধরে সারিন্দাটি আমার সঙ্গী। এটি শুধু আমার ছিল না, আমাদের ছিল। কষ্টটা যে কী পরিমাণ পেয়েছি, তা ভাষা দিয়ে প্রকাশ করা যাবে না।
লালনশিল্পী খোকন চিশতী, মামলার বাদী

এ ঘটনায় ভুক্তভোগী লালনসংগীতশিল্পী খোকন চিশতী গতকাল সোমবার দিবাগত রাতে তিনজনের নাম উল্লেখসহ ৬ থেকে ৭ জনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেন। পুলিশ অভিযান চালিয়ে প্রধান আসামি শেখ জাহাঙ্গীরকে গ্রেপ্তার করেছে। মামলায় নাম উল্লেখ করা অন্য আসামিরা হলেন শাহীন শেখ (৩২) ও ফজলু শেখ (৫৮)। প্রধান আসামি শেখ জাহাঙ্গীরের বাড়ি ঘটনাস্থল থেকে ২০০ মিটার দূরত্বে। পেশায় সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক জাহাঙ্গীর এলাকায় মাদকাসক্ত ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত।

মঙ্গলবার দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, কয়েকজন শিল্পী গুঁড়িয়ে দেওয়া বাদ্যযন্ত্র পাশে নিয়ে বসে আছেন। সেদিন কী ঘটেছিল, জানতে চাইলে তাঁরা জানান, রোববার দুপুরে তাঁরা আশ্রমে বসে নিজেদের বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গান করছিলেন। বেলা দুইটার দিকে জাহাঙ্গীর নামের স্থানীয় একজন এসে তাঁদের কাছে পানি চান। পানি দেওয়ার পর নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তিনি শিল্পীদের গালিগালাজ শুরু করেন। পরে শিল্পীরা তাঁকে বাগানের বাইরে বের করে দেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে জাহাঙ্গীর কিছুক্ষণ পর তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে হামলা করেন। লাঠিসোঁটা ও রড নিয়ে তাঁদের তাড়া করলে ভয়ে তাঁরা দৌড়ে গঙ্গাজলী নদীর অপর প্রান্তে চলে যান। তাঁরাও নদী পার হয়ে তাঁদের কয়েকজনকে মারধর করেন। পরে আশ্রমে ফিরে শিল্পীদের সব বাদ্যযন্ত্র ভেঙে গুঁড়িয়ে দেন তাঁরা।

Also Read: বেলাবতে লালনশিল্পীদের বাদ্যযন্ত্র গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় মামলা, প্রধান আসামি গ্রেপ্তার

গ্রেপ্তার প্রধান আসামি শেখ জাহাঙ্গীর

লালনশিল্পীরা বলেন, হামলাকারীরা তাঁদের মারধর করার জন্যই রড নিয়ে এসেছিলেন। শিল্পীরা নদী পার হয়ে পালালে সেই রাগ বাদ্যযন্ত্রের ওপর মিটিয়েছেন। জাহাঙ্গীর নেশাগ্রস্ত থাকলেও সঙ্গে আসা ব্যক্তিরা নেশাগ্রস্ত ছিলেন না। বাদ্যযন্ত্রগুলোর কী দোষ ছিল, প্রশ্ন তাঁদের। তাঁরা বলেন, একজন শিল্পীর কাছে তাঁর বাদ্যযন্ত্রের চাইতে মূল্যবান আর কিছুই নেই। রড দিয়ে যখন একের পর এক বাদ্যযন্ত্র ভাঙা হচ্ছিল, একজন তবলাবাদক তাঁদের কাছে গিয়ে বাদ্যযন্ত্রগুলো না ভাঙার অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু তাঁরা শোনেননি।

বাগানমালিক ও আশ্রমের তত্ত্বাবধায়ক মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমি ১৯৯৪ সাল থেকে লালনভক্ত। ২০১৭ সালে যখন বাগানে গাছ লাগানো শুরু করি, তখন থেকেই আশ্রমের কাজও শুরু হয়। তখন থেকে স্থানীয় লালনভক্তরা নিয়মিত যাতায়াত করেন। বছরে চার-পাঁচবার দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিল্পীরা এসে সাধুসঙ্গ করেন। এসব শিল্পী তো আমাদের অতিথি। তাঁরা কারও সাতেপাঁচেও নেই। তাঁরা গান করেন মনের আনন্দে। তাঁদের ওপর হামলা করে বাদ্যযন্ত্র ভেঙে দেওয়ার ঘটনা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যাচ্ছে না।’

Also Read: বেলাবতে গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো সাধুসঙ্গে আসা লালনশিল্পীদের বাদ্যযন্ত্র

মামলার বাদী লালনসংগীতশিল্পী খোকন চিশতী বলেন, ‘আট বছর ধরে কখনো দোতরা, কখনো সারিন্দা বাজিয়ে লালনের গান করি আমি। গুরুর সহযোগিতায় বাবার বয়সী এক ব্যক্তি আমাকে ১৫০ বছরের পুরোনো একটি সারিন্দা দিয়েছিলেন। ছয় বছর ধরে সারিন্দাটি আমার সঙ্গী। এটি শুধু আমার ছিল না, আমাদের ছিল।’ সারিন্দা বাজিয়ে সুর তোলার একটি ভিডিও দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘কষ্টটা যে কী পরিমাণ পেয়েছি, তা ভাষা দিয়ে প্রকাশ করা যাবে না।’

অভিযুক্ত জাহাঙ্গীরের বাড়িতে গিয়ে তাঁর স্বজনদের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন জানান, ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর পড়াশোনা ছেড়ে কাজে নামেন জাহাঙ্গীর। স্ত্রীকে মারধরের কারণে তাঁর বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলা চলমান।

নরসিংদীর বেলাবতে সাধুসঙ্গে আসা লালনশিল্পীদের ২০টি বাদ্যযন্ত্র ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। ছবিটি সোমবার দুপুরে তোলা

এদিকে মামলার প্রধান আসামি শেখ জাহাঙ্গীরকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ সুপার কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছে জেলা পুলিশ। সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) অনির্বাণ চৌধুরী বলেন, শিল্পীদের বাদ্যযন্ত্র ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা জানার পরপরই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ভুক্তভোগী শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলেছে পুলিশ। গতকাল রাতে ভুক্তভোগী শিল্পী খোকন চিশতী মামলা করেন। রাতেই আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযানে নামে পুলিশ। পলাতক প্রধান আসামি জাহাঙ্গীরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এক প্রশ্নের জবাবে অনির্বাণ চৌধুরী বলেন, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় জাহাঙ্গীর ঘটনাটি ঘটিয়েছেন বলে তাঁদের কাছে স্বীকার করেছেন। এ ঘটনায় বিস্তারিত জানতে তদন্ত করছে পুলিশ।

বেলাব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তানভীর আহমেদ বলেন, সংবাদ সম্মেলনের পর গ্রেপ্তার জাহাঙ্গীরকে আদালতে পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িত অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। তাঁরা এলাকাছাড়া। দ্রুত তাঁদের গ্রেপ্তার করা হবে।