গাজীপুরে সাংবাদিক আসাদুজ্জামানকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় দুই কারণ সামনে রেখে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। এর একটি হচ্ছে গাজীপুরে চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও ছিনতাইকারী দলের ধাওয়া দেওয়ার ভিডিও ধারণ করা এবং আরেকটি হচ্ছে পূর্বশত্রুতার বিষয়। পুলিশের দাবি, ইতিমধ্যে ঘটনাস্থলের আশপাশের সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করে হত্যাকারীদের চিহ্নিত করেছে তারা। তাঁদের মধ্যে চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন মো. মিজান ওরফে কেটু মিজান, তাঁর স্ত্রী গোলাপি, মো. স্বাধীন ও আল আমিন। পুলিশ জানিয়েছে, সিসিটিভির ফুটেজ দেখে এই চারজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাঁরা ছিনতাইকারী দলের সদস্য। এর আগে এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পুলিশ গত বৃহস্পতিবার রাতে গাজীপুর নগরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে পাঁচজনকে আটক করে।
পুলিশ জানায়, আসাদুজ্জামান হত্যাকাণ্ডের কিছুক্ষণ পরই স্থানীয় একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়। সেই ফুটেজ দেখে ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করা হয়। এরপর তাঁদের গ্রেপ্তার করতে পুলিশের তিনটি দল ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় অভিযানে নামে। গতকাল রাত আনুমানিক ১০টার দিকে গাজীপুর সদর উপজেলার ভবানীপুর থেকে মো. মিজান ওরফে কেটু মিজান ও তাঁর স্ত্রী গোলাপিকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশের অপর একটি দল গাজীপুর শহরের পাশ থেকে স্বাধীনকে গ্রেপ্তার করে। এ ছাড়া রাত সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর তুরাগ এলাকা থেকে আল আমিনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
পুলিশ জানায়, আসাদুজ্জামান হত্যাকাণ্ডের কিছুক্ষণ পরই স্থানীয় একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়। সেই ফুটেজ দেখে ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করা হয়।
গাজীপুর মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ) তাহেরুল হক চৌহান প্রথম আলোকে বলেন, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অন্যদের গ্রেপ্তার করতে অভিযান চলছে।
আসাদুজ্জামানকে হত্যার ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার সকালে সাংবাদিক আসাদুজ্জামানের বড় ভাই মো. সেলিম বাদী হয়ে নগরের বাসন থানায় মামলাটি দায়ের করেন।
গাজীপুর নগরের চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় গত বৃহস্পতিবার রাত আটটার দিকে আসাদুজ্জামানকে (৩৮) সন্ত্রাসী ও ছিনতাইকারীরা কুপিয়ে হত্যা করে। তিনি দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ-এর স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কাজ করতেন। তাঁর বাড়ি ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার ভাটিপাড়া গ্রামে।
ওই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে গাজীপুর মহানগর পুলিশের উপকমিশনার রবিউল হাসান বলেন, সাংবাদিক আসাদুজ্জামানকে কুপিয়ে হত্যার আগমুহূর্তের কিছু দৃশ্য সিসিটিভির ফুটেজ পাওয়া গেছে। এতে দেখা যায়, চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও ছিনতাইকারী দলের সদস্যরা ধারালো দেশি অস্ত্র নিয়ে এক ব্যক্তিকে ধাওয়া করে। পেছন থেকে সেই দৃশ্য ভিডিও করছিলেন আসাদুজ্জামান। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, এই দৃশ্য ভিডিও করায় তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
ওই ভিডিওতে দেখা যায়, ঘটনাস্থল চন্দনা চৌরাস্তা মসজিদ মার্কেটের পশ্চিম পাশে। গতকাল সন্ধ্যা ৬টা ৫৮ মিনিট। কালো রঙের জামা পরা এক নারী হেঁটে যাচ্ছেন। পেছন দিক থেকে নীল রঙের জামা পরা এক ব্যক্তি ওই নারীকে টেনে ধরেন। নারী জোর করে চলে যেতে চাইলে তাঁর সামনে গিয়ে গতি রোধ করেন ওই ব্যক্তি। একপর্যায়ে ওই ব্যক্তি নারীকে চড়থাপ্পড় মারেন। ঠিক এমন সময় পাশ থেকে ধারালো অস্ত্র হাতে কয়েক যুবক ওই ব্যক্তিকে কোপানোর চেষ্টা করেন। এতে নীল শার্ট পরা ওই ব্যক্তি দৌড়ে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যান।
ওই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে গাজীপুর মহানগর পুলিশের উপকমিশনার রবিউল হাসান বলেন, সাংবাদিক আসাদুজ্জামানকে কুপিয়ে হত্যার আগমুহূর্তের কিছু দৃশ্য সিসিটিভির ফুটেজ পাওয়া গেছে। এতে দেখা যায়, চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও ছিনতাইকারী দলের সদস্যরা ধারালো দেশি অস্ত্র নিয়ে এক ব্যক্তিকে ধাওয়া করে। পেছন থেকে সেই দৃশ্য ভিডিও করছিলেন আসাদুজ্জামান।
ঘটনার কিছু সময় আগে চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় একটি দোকানে বসে ছিলেন সাংবাদিক আসাদুজ্জামান ও তাঁর সহকর্মী শামীম হোসেন। ওই ঘটনা সম্পর্কে শামীম হোসেন বলেন, ‘চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় আমরা দুজন এক দিক থেকে অন্য পাশে হেঁটে যাচ্ছিলাম। ঠিক এমন সময় একজন নারী ও পুরুষ আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে যান। এমন সময় কয়েকজন লোক দেশি ধারালো অস্ত্র নিয়ে বলতে থাকে, “এই পাইছি, তোরা আয়।” এ সময় ওই পুরুষ দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। তখন তাঁরা ধারালো অস্ত্র নিয়ে তাঁকে ধাওয়া করেন। তখন তুহিন (সাংবাদিক আসাদুজ্জামান) মুঠোফোন বের করে তাঁদের পেছনে দৌড় দেন। পরে আমি তুহিনকে খুঁজতে এগিয়ে যাই। অস্ত্রধারী ব্যক্তিরা হঠাৎ থেমে গিয়ে পেছনে তাকায়। তুহিন তখন দৌড়ে চায়ের দোকানে ঢুকে যায়। ঠিক ওই মুহূর্তে ওরাও চায়ের দোকানে ঢুকে ওকে কুপিয়ে হত্যা করে পালিয়ে যায়। আমি চৌরাস্তা এলাকায় পুলিশের গাড়ি খুঁজতে থাকি। কোনো গাড়ি দেখতে না পেয়ে বাসন থানার ওসিকে ফোন করি। কিছু সময় পর পুলিশ আসে।’
নারীর সঙ্গে যে ব্যক্তির ধস্তাধস্তি হয়েছিল ও পরে যিনি পালিয়ে গিয়েছিলেন, সেই ব্যক্তি আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছেন। তাঁর নাম বাদশা মিয়া। তিনি বলেন, ‘ওই মেয়েসহ একটা টিম আছে। ওরা আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে গেছে।’
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গাজীপুর নগরের বাসন, ভোগরা ও চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় একটি চক্র আছে, যারা ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত। সিসিটিভির ফুটেজে যাদের দেখা গেছে, তারা সবাই ছিনতাইকারী দলের সদস্য। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। ভিডিওতে যে নারীকে দেখা গেছে, তিনিও ওই চক্রের সদস্য হতে পারেন। চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ পেতে ওই চক্র ছিনতাই করে থাকে।
এই বিষয়ে গাজীপুর মহানগর পুলিশের উপকমিশনার রবিউল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ধারণা করছি, সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজের ওই মেয়ে ছিনতাইকারী দলের সদস্য।
কালো রঙের জামা পরা এক নারী হেঁটে যাচ্ছেন। পেছন দিক থেকে নীল রঙের জামা পরা এক ব্যক্তি ওই নারীকে টেনে ধরেন। নারী জোর করে চলে যেতে চাইলে তাঁর সামনে গিয়ে গতি রোধ করেন ওই ব্যক্তি। একপর্যায়ে ওই ব্যক্তি নারীকে চড়থাপ্পড় মারেন। ঠিক এমন সময় পাশ থেকে ধারালো অস্ত্র হাতে কয়েক যুবক ওই ব্যক্তিকে কোপানোর চেষ্টা করেন।
হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে গতকাল রাজনৈতিক ও পেশাজীবী সংগঠন ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় বিক্ষোভ করেন। গতকাল সকালে গাজীপুর প্রেসক্লাবের সামনে এই কর্মসূচির আয়োজন করে সাংবাদিক ইউনিয়ন। এই সময় সাংবাদিকেরা হত্যার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি জানান।
এদিকে হত্যার ঘটনায় জড়িতদের আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন রাজধানীতে কর্মরত বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকেরা। গতকাল বিকেলে ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক মানববন্ধনে সাংবাদিকেরা এ দাবি জানান। সাংবাদিককে প্রকাশ্যে হত্যার প্রতিবাদ এবং সাংবাদিকদের পেশাগত রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবিতে মাল্টিমিডিয়া রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন, জুলাই রেভল্যুশনারি জার্নালিস্ট অ্যালায়েন্স ও বিক্ষুব্ধ সাংবাদিক সমাজ-এর ব্যানারে এই মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়।
গাজীপুরের সাংবাদিক হত্যায় জড়িতদের গ্রেপ্তারে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও গণ অধিকার পরিষদ ২৪ ঘণ্টার সময়সীমা (আলটিমেটাম) দিয়েছে। এ ছাড়া গণ অধিকার পরিষদের নেতা-কর্মীরা মিছিল নিয়ে বাসন থানায় যান। পরে তাঁরা থানা ঘেরাও করে জড়িতদের গ্রেপ্তারের দাবি জানান।
সাংবাদিক আসাদুজ্জামানকে যেখানে সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে হত্যা করে, তার পাশেই গতকাল জুমার নামাজের পর চান্দনা মসজিদ মাঠে তাঁর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে তাঁর মরদেহ বেলা তিনটার দিকে গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার ভাটিপাড়া নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সন্ধ্যা ৭টা ২০ মিনিটের দিকে বাড়ির পাশের ভাটিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। এর আগে সন্ধ্যা সোয়া ছয়টার দিকে তাঁর মরদেহ পৌঁছায় নিজ গ্রামে। মরদেহ রাখা হয় বাড়ির পাশের ফুলবাড়িয়া ভাটিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে। এ সময় সেখান শোকাবহ পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
ছেলে হারানোর শোকে মুহ্যমান আসাদুজ্জামান তুহিনের বাবা হাসান জামাল বলেন, ‘আমার ছেলেডারে কেন এভাবে মারল, কী অপরাধ আছিন আমার ছেলের? আমি তো কোনো দিন কারও ক্ষতি করি নাই, আমার ছেলেও তো মানুষের ক্ষতি করত না। যে ছেলে দুই দিন আগে আমার ওষুধ কেনার টাকা পাঠাইল, সেই ছেলেই আজ হত্যার শিকার হইল। ওরা কেন এভাবে মারল ছেলেডারে?’
গাজীপুর নগরের সাহাপাড়া এলাকায় সাংবাদিককে মারধরের ঘটনায় করা মামলার প্রধান আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গত বৃহস্পতিবার রাতে সাহাপাড়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। গতকাল শুক্রবার আদালতের মাধ্যমে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়।
গ্রেপ্তার ব্যক্তির নাম মো. ফরিদ (৩৭)। তিনি সাহাপাড়া এলাকার বাসিন্দা। ভুক্তভোগী সাংবাদিকের নাম আনোয়ার হোসেন (৩৫)। তিনি দৈনিক বাংলাদেশের আলো পত্রিকার গাজীপুরের স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কর্মরত।
গত বুধবার বিকেলে সাহাপাড়া এলাকায় চাঁদাবাজির সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে তিনি হামলার শিকার হন। এ ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। পরে আহত সাংবাদিকের মা বাদী হয়ে থানায় একটি লিখিত এজাহার দেন। পরে সেটি মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হয়।
গাজীপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মেহেদী হাসান বলেন, সাংবাদিককে মারধর করার ঘটনায় জড়িত একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যদের গ্রেপ্তার করতে অভিযান অব্যাহত আছে।