বাদশা মিয়া
বাদশা মিয়া

‘একমুঠো ভাত নয়, একমুঠো অক্সিজেন চাই’ স্লোগানে ২০ বছর ধরে গাছ লাগাচ্ছেন দিনমজুর বাদশা

রংপুরের পীরগঞ্জের বাদশা মিয়ার লাগানো গাছের ফল খান এলাকার মানুষ। গাছের ছায়ায় বসে মনপ্রাণ জুড়ায় পথচারীরা।

প্রত্যন্ত গ্রামের শানেরহাট বাজারটি বেশ বড়। বাদশা মিয়া নামের এক ব্যক্তিকে খুঁজতে তাই এ দোকান–ও দোকানে জিজ্ঞাসা করতে হলো। মনিরুল নামের এক দোকানি চিনতে পারলেন। নিশ্চিত হওয়ার জন্য পাল্টা জানতে চান, ‘গাছের বন্ধু বাদশাকে খুঁজছেন?’

হ্যাঁ-সূচক উত্তর পেয়ে বাজারের মসজিদ প্রাঙ্গণে একটি আমগাছ দেখিয়ে মনিরুল জানালেন, সেটি বাদশা মিয়ার লাগানো। বাদশার কাছে নিজের লাগানো গাছগুলো সন্তানের মর্যাদা পায় উল্লেখ করে মনিরুল বলেন, তিনি দেখেছেন, ওই আমগাছটি কী গভীর মমতায় বড় করেছেন বাদশা! বাজারে এলেই গাছটি ছুঁয়ে আদর করেন তিনি।

বাদশা মিয়ার বাড়ি রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে শানেরহাট ইউনিয়নের মেষ্টা গ্রামে। স্থানীয় লোকজন ভালোবেসে তাঁকে ‘গাছের বন্ধু বাদশা’ নামে ডাকেন। তাঁর পেশা দিনমজুরি হলেও নেশা গাছ লাগানো। নিজের টাকায় রাস্তার পাশে, হাটবাজার ও গ্রামের মোড়ে, ঈদগাহ, মসজিদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাঠে ২০ বছর ধরে গাছের চারা লাগিয়ে চলেছেন তিনি। এখন তাঁর লাগানো গাছের ফল খান এলাকার মানুষ। গাছের ছায়ায় বসে মনপ্রাণ জুড়ায় পথচারীরা।

নিশ্চিত হওয়ার জন্য পাল্টা জানতে চান, ‘গাছের বন্ধু বাদশাকে খুঁজছেন?’ হ্যাঁ-সূচক উত্তর পেয়ে বাজারের মসজিদ প্রাঙ্গণে একটি আমগাছ দেখিয়ে মনিরুল জানালেন, সেটি বাদশা মিয়ার লাগানো।

এলাকার অনেকেই বাদশাকে ‘পাগল’ বলে উপহাস করতেন বলে জানালেন মেষ্টা গ্রামের বাসিন্দা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য মোফাজ্জল হোসেন। তিনি বলেন, কটুকথায় বাদশা থামেননি। সবাইকে বুঝিয়েছেন গাছের উপকারিতার কথা। এখন সবাই তাঁর পাগলামির সুফল ভোগ করছেন।

মেষ্টা গ্রামের ফসলি মাঠের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে শানেরহাট-বড়দরগা পিচঢালা সড়ক। সড়কের দুই পাশে সারি সারি নানা ফলের গাছ। সম্প্রতি (গত ২৭ সেপ্টেম্বর) সেই পথ ধরে বাদশার বাড়িতে ঢুকেই মন জুড়িয়ে যায়। গাছে গাছে সাজানো লম্বা পথ পেরিয়ে তারপর আধা পাকা টিনশেড বাড়ি। পথের দুই পাশে সবজি, ফল আর ফুলের গাছ। তবে বাড়িতে কাউকে পাওয়া গেল না।

বাদশাকে খুঁজতে যেতে হলো শানেরহাট বাজারে। সেখানে দেখা গেল, বাদশা পথের ধারে লাগানোর জন্য চারাগাছ কিনছেন। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তিনি বড়দরগা–শানেরহাট সড়কে নিয়ে গেলেন। দেখালেন, দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নিজের লাগানো গাছ। গাছের নিচে নিজের হাতে স্থাপন করা একটি বাঁশের বেঞ্চে বসে শোনালেন গাছ লাগানোর গল্প।

এলাকার অনেকেই বাদশাকে ‘পাগল’ বলে উপহাস করতেন বলে জানালেন মেষ্টা গ্রামের বাসিন্দা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য মোফাজ্জল হোসেন। তিনি বলেন, কটুকথায় বাদশা থামেননি। সবাইকে বুঝিয়েছেন গাছের উপকারিতার কথা।

কৃষকের সন্তান বাদশা মিয়া আর্থিক অনটনে লেখাপড়া করতে পারেননি। সাত বছর বয়সে তিনি মাঠে ছাগল, গরু চরানোর কাজ শুরু করেন। একটু বড় হওয়ার পর পেশা দাঁড়ায় দিনমজুরি। সংসারে তাঁর এক ছেলে ও এক মেয়ে। কৃষিজমি নেই। চার শতক জমির ওপর তাঁর বাড়ি।

স্থানীয় লোকজন জানান, প্রায় ১০ বছর ধরে শুক্রবার এলেই ৭২ বছর বয়সী বাদশা মিয়া বাইসাইকেলের পেছনে গাছের চারা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। ইউনিয়নের যেকোনো মসজিদে জুমার নামাজ আদায়ের পর গাছের উপকারিতা সম্পর্কে লোকজনকে ধারণা দেন। গাছের চারা উপহার দিয়ে গাছ লাগানোরও পরামর্শ দেন।

নিজের সন্তানদের কথা ভাবতে গিয়ে গরিব প্রতিবেশীর সন্তানদের কথাও মাথায় আসে তাঁর। একসময় মনে হলো, তাদের জন্য কিছু একটা করতে হবে। সেখান থেকেই ফলের গাছ লাগানোর সিদ্ধান্ত নেন।

ফল কিনতে না পেরে বৃক্ষরোপণ

২০০৪ সালের নভেম্বর মাসের এক বিকেল। বাদশা তাঁর দুই সন্তান মিলন মিয়া ও লাভলি আক্তারকে নিয়ে বাড়ির পাশের রাস্তার ধারে বসে ছিলেন। ওই পথ দিয়ে আম-কাঁঠাল নিয়ে বাজারে যাচ্ছিলেন এক ব্যবসায়ী। তা দেখে দুই সন্তান বাবার কাছে ফল খাওয়ার আবদার করেন। টাকার অভাবে সন্তানদের সেদিন ফল খাওয়াতে না পেরে বাদশা খুব কষ্ট পান। নিজের সন্তানদের কথা ভাবতে গিয়ে গরিব প্রতিবেশীর সন্তানদের কথাও মাথায় আসে তাঁর। একসময় মনে হলো, তাদের জন্য কিছু একটা করতে হবে। সেখান থেকেই ফলের গাছ লাগানোর সিদ্ধান্ত নেন।

পরের বছরের জুলাই মাসে শানেরহাট-বড়দরগা সড়কের পাশে ৫০টি আম ও কাঁঠালগাছ লাগান। বাদশা মিয়া জানালেন, ওই সময় দুই–তিন মাসে সড়কে ১৫০টি গাছ লাগানোর পর আর্থিক সংকটে পড়ে যান। গাছের গোড়ায় খুঁটি দেওয়ার টাকা পাচ্ছিলেন না। শেষে মেয়ের কানের সোনার রিং বিক্রি করে খুঁটি দেন। স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করেন, দিনমজুরি করে যে টাকা আয় করবেন, তার চার ভাগের এক ভাগ গাছ লাগানোর কাজে ব্যয় করবেন। স্ত্রী মিনারা বেগমও তাঁকে গাছ লাগানোর কাজে সব সময় উৎসাহ দেন।

শানেরহাট ইউপি চেয়ারম্যান মেছবাহুর রহমান বলেন, সরকারি রাস্তায় গাছ লাগিয়ে বাদশা মিয়া গরিব মানুষের মুখে ফল তুলে দিচ্ছেন। পথচারীদের বিশ্রামের জন্য গাছের নিচে বাঁশের টং তৈরি করে দিয়েছেন। তাঁর এ উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার।

সড়কের দুই ধারে বাদশা মিয়ার হাতে লাগানো গাছ। সম্প্রতি রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার শানেরহাট-বড়দরগা সড়কে

শুরুতে বাধা, এখন মিলছে স্বীকৃতি

বাদশা দুঃখ করে জানান, প্রথম দিকে সড়কের পাশে গাছের চারা লাগাতে গিয়ে মানুষের বাধার মুখে পড়েন। ২০০৫ সালে তাঁর লাগানো গাছগুলো রাস্তার পাশের জমির মালিকেরা উপড়েও ফেলেন। এ নিয়ে প্রতিবাদ করলে তাঁকে রাস্তায় ফেলে মারধরও করা হয়। এ কারণে মনে কষ্ট নিয়ে সবকিছু বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

তাঁর হিসাবে, এ পর্যন্ত ৩০ হাজারের বেশি আম, জাম, কাঁঠাল, আমড়া, লিচু, পেয়ারা, নারকেল, খেজুর, চালতা, কামরাঙা, বেল, আতাগাছ লাগিয়েছেন। ২০০৬-০৭ সালের দিকে রোপণ করা গাছগুলো এখন বড় হয়েছে।

কিন্তু বেশি দিন বসে থাকতে পারেননি। ২০০৬ সালের পর নতুন উদ্যমে শুরু করে আর থামেননি। এখন ৭২ বছর বয়সেও ‘একমুঠো ভাত নয়, একমুঠো অক্সিজেন চাই’ স্লোগান ধারণ করে তিনি গাছ লাগিয়ে চলেছেন। শুধু নিজের গ্রামেই নয়; পাশের হাজীপুর, সোকিপুর, স্বাদপুর, শান্তিপুর, নিরাজপুর, বাজাতপুর, পার্বতীপুরসহ অন্তত ১৫ গ্রামজুড়ে রয়েছে তাঁর লাগানো নানা প্রজাতির ফলের গাছ। তাঁর হিসাবে, এ পর্যন্ত ৩০ হাজারের বেশি আম, জাম, কাঁঠাল, আমড়া, লিচু, পেয়ারা, নারকেল, খেজুর, চালতা, কামরাঙা, বেল, আতাগাছ লাগিয়েছেন। ২০০৬-০৭ সালের দিকে রোপণ করা গাছগুলো এখন বড় হয়েছে।

মেষ্টা গ্রামের পাশের শানেরহাট গ্রামের সংবাদকর্মী রেজাউল ইসলাম বলেন, কোনো স্বীকৃতির কথা না ভেবে গাছ লাগিয়ে চলেছেন বাদশা। শানেরহাট ইউনিয়নে এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কমই আছে, যেখানে তিনি একটি গাছও লাগাননি।

এখন পুরো সংসারের ভার আমার ওপর। বাবা যা আয় করেন, সে টাকা দিয়ে গাছ লাগান। গ্রামের কারও বিপদ হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বাবার কাজে আমরা খুশি।
মিলন মিয়া

কাজের স্বীকৃতি হিসেবে গত বছরের ২৭ অক্টোবর বৃক্ষমেলায় উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাদশাকে পুরস্কৃত করা হয়েছে। এ ধরনের ভালো কাজে এগিয়ে আসায় বাদশাকে আরও উৎসাহিত করা হচ্ছে বলে জানালেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খাদিজা বেগম।

বাবার জন্য গর্ব হয় বলে জানালেন ছেলে মিলন মিয়া। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন পুরো সংসারের ভার আমার ওপর। বাবা যা আয় করেন, সে টাকা দিয়ে গাছ লাগান। গ্রামের কারও বিপদ হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বাবার কাজে আমরা খুশি।’

নিজের লাগানো গাছ থেকে লাভবান হওয়ার কোনো চিন্তা করেন না বাদশা মিয়া। তবে চান, তাঁর কাজের মাধ্যমে আগামী প্রজন্ম উপলব্ধি করবে, সমাজ ও পরিবেশের জন্য কিছু একটা রেখে যেতে হয়। তিনি বলেন, ‘গাছ অক্সিজেন দিয়ে প্রতিমুহূর্ত আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। আল্লাহ তাআলা যত দিন সুযোগ দেবেন, তত দিন গাছ লাগাব। আমি বেঁচে না থাকলেও আমার গাছ বেঁচে থাকবে। মানুষকে ছায়া, ফল দেবে। তাতেই আমার সুখ।’