স্থানীয় লোকজন মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে কিংবা ভ্যান ও সাইকেলে ছুটে চলেছেন খাওয়ার পানি সংগ্রহে।

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার অধিকাংশ গ্রামে সুপেয় পানির তীব্র সংকটে ভুগছেন বাসিন্দারা। এই উপকূলীয় এলাকায় যেদিকে চোখ যায়, পানি আর পানি। শুধু খাওয়ার উপযোগী একটু পানি নেই। বর্ষার সময় বৃষ্টির পানি ধরে রেখে মাস ছয়েক চালিয়ে নিতে পারলেও বছরের বাকি সময় তাঁরা প্রচণ্ড পানির কষ্টে পড়েন। গত কয়েক দিনের দাবদাহে খাওয়ার পানির সংকট আরও বেড়েছে। স্থানীয় লোকজন মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে কিংবা ভ্যান ও সাইকেলে ছুটে চলেছেন পানি সংগ্রহে।
১৮ এপ্রিল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে উপজেলার কাশিমাড়ী ইউনিয়নের দেওল গ্রামে দেখা যায়, ওই গ্রামের তিন রাস্তার মোড়ে কয়েক শ নারী ও শিশু এসেছে খাওয়ার পানি সংগ্রহে। সেখানে বন্ধু নামের একটি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) পাশের উপজেলার গভীর নলকূপের পানি পাইপে সরবরাহ করে। একেকজন এক কলসি পানি নেওয়ার জন্য সেই সকাল থেকে দীর্ঘক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছেন।
জাহিদুল ইসলামের বাড়ির সামনের গাছের নিচে ৩ ঘণ্টা ধরে বসে আছেন ৬৫ বছরের বৃদ্ধা মর্জিনা বিবি। এক কিলোমিটার দূরের কাঠালবাড়িয়া গ্রাম থেকে এ বয়সেও দুটি কলস টেনে এনে লাইনে রেখেছেন তিনি। ভিড় বেশি হওয়ায় লাইনে এগিয়ে থাকতে সকাল ৮টার দিকে এলেও বেলা ১১টা পর্যন্ত পানি সংগ্রহ করতে পারেননি। কলসে পানিভর্তি করে খবর দিলে দুপুর ১২টার দিকে নাতি অথবা তাঁর মেয়ে এসে অপর কলস নিয়ে যাবে। ষাটোর্ধ্ব মর্জিনা বলেন, ‘রদ্দুরে গতর জ্বলে যেতেছে। পানির জন্যি পরানডা যায়, পানির অনেক কষ্ট, এটটু পানি দিলি বড্ড খুশি হুতাম।’
পাশে দাঁড়ানো পুষ্প রানী মণ্ডল বলেন, ‘আমাগো পানির বিশাল কষ্ট।’ তিন কিলোমিটার দূরবর্তী শংকরকাঠি মোল্যাপাড়া থেকে পানি নিতে এসেছেন পুষ্প রানী। ছয় সদস্যের পরিবারের জন্য প্রতিদিন তাঁকে দুবার পানি টানতে হয় জানিয়ে বলেন, দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় নষ্ট হয়। গৃহস্থালি কাজ করতে পারেন না ঠিকমতো। মাঝেমধ্যে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলেকে পানি টানার কাজে লাগাতে হয়। চারদিকে অজস্র জলরাশি (চিংড়ি ঘের)। এ সত্ত্বেও তপ্ত দুপুরের রোদে শুধু খাওয়ার পানির জন্য মাইলের পর মাইল রাস্তা পাড়ি দিতে হয় বলে আক্ষেপ করেন তিনি।
পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় অধিকাংশ নলকূপে পানি কম উঠছে। বৃষ্টির অভাব ও পুকুর–জলাধার শুকিয়ে যাওয়ায় আরডব্লিউএইচ ও পিএসএফ ঠিকভাবে কাজ করছে না। ফলে পানির সংকট বেড়েছে।মোস্তাফিজুর রহমান, উপসহকারী প্রকৌশলী, শ্যামনগর উপজেলা জনস্বাস্থ্য বিভাগ
দেওল তিন রাস্তার মোড়ে একটি ট্যাপ বসানো হয়েছে। ওই ট্যাপে পানি আসছে পাঁচ-ছয় কিলোমিটার দূরের কালীগঞ্জ উপজেলার সোতা গ্রামের ইমান আলীর বাড়ি থেকে। সেখানে বন্ধু এনজিও সৌরবিদ্যুৎ–চালিত গভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি উত্তোলন করে আশপাশের গ্রামে সরবরাহ করে। সূর্য ওঠার পর সোলার প্যানেলের শক্তি সঞ্চয় শেষে ইমান আলীর বাড়িতে বসানো ট্যাংক ভর্তি করে পানি ছাড়া হয় সকাল ১০টার পর। সেই পানি দেওল গ্রামে পৌঁছাতে বেলা ১১টা বেজে যায়। দুই-তিন কিলোমিটার দূরবর্তী পাটনীপুকুর, কাঠালবাড়িয়া, খুটিকাটা ও শংকরকাঠি এলাকা থেকেও কয়েক শ নারী ও শিশু সেখানে এসেছেন খাবার পানি সংগ্রহে। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার কথা জেনেও তাঁরা সাতসকাল থেকে দেওল তিন রাস্তার মোড়ে জড়ো হয়েছেন খাওয়ার একটু পানির জন্য।
পানি নিতে আসা নারী ও শিশুরা জানায়, দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে গিয়ে সময় অপচয়ের পাশাপাশি তাদের প্রচণ্ড রকমের কষ্ট হয়। তবে খাওয়ার উপযোগী পানি নিয়ে এমন কষ্ট কেবলমাত্র দেওল আর তৎসংলগ্ন পাড়নীপুকুর, শংকরকাঠি, কাঠালবাড়িয়া এলাকায় নয়, শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনীর মহসীন সাহেবের হুলো, কাঁচড়াহাটিসহ উপজেলার প্রায় সর্বত্র এমনই পরিস্থিতি। দাবদাহে খাওয়ার পানির সংকট আরও বেড়েছে।
স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এলাকার সিংহভাগ নলকূপের পানি লবণাক্ত। পন্ড স্যান্ড ফিল্টার (পিএসএফ) পদ্ধতিতে পুকুরের পানি ব্যবহারের সুযোগ থাকলেও অধিকাংশ মিষ্টি পানির পুকুর ও জলাধার শুকিয়ে পানিশূন্য হয়ে গেছে। এ ছাড়া কিছু এলাকায় নতুনভাবে ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট গড়ে উঠলেও পানি সংগ্রহ ব্যয় অনেক বেশি। আবার সেগুলোর অধিকাংশই দূরবর্তী এলাকায়। সব মিলিয়ে উপকূলবর্তী শ্যামনগর এলাকাজুড়ে খাওয়ার পানির সংকট প্রকট হচ্ছে।
শ্যামনগর উপজেলা জনস্বাস্থ্য বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় অধিকাংশ নলকূপে পানি কম উঠছে। শুধুমাত্র দুর্যোগকালীন সময়ে সরকারিভাবে দুর্গতদের মধ্যে খাওয়ার পানি বিতরণ করা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, পানি সমস্যা দূরীকরণে শ্যামনগরে জনস্বাস্থ্য বিভাগের পিএসএফ, আরডব্লিউএইচ (রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং), গভীর ও অগভীর নলকূপ, আরও (রিভার্স অসমোসিস), পুকুর, দিঘি, মার (ম্যানেজ একুইফার রিসার্চ) মিলিয়ে প্রায় ৭ হাজার পানির উৎস রয়েছে। তবে বৃষ্টির অভাব ও পুকুর–জলাধার শুকিয়ে যাওয়ায় আরডব্লিউএইচ ও পিএসএফ ঠিকভাবে কাজ করছে না। ফলে পানির সংকট বেড়েছে।
মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, কিছু এনজিও পানি সরবরাহের কাজ করলেও জনস্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় না করায় তাদের পানি সরবরাহের বিষয়ে কোনো তথ্য তাঁদের কাছে নেই।