
চালের তৈরি ধোঁয়া ওঠা সেদ্ধ নুডলসের মধ্যে গোলমরিচ, পাহাড়ি মরিচের গুঁড়া, পেঁয়াজ ভাজা, ধনেপাতা, চিংড়ি ও শুঁটকিসহ নানা মসলা দিয়ে পরিবেশন করা হয়। সঙ্গে নানা রকমের চাটনি ও সেঁকা কাবাব। ঐতিহ্যবাহী এই খাবারের নাম মুংডি। ঐতিহ্যবাহী এই খাবার খেতে হলে আপনাকে যেতে হবে বান্দরবানে। জেলা শহরের উজানিপাড়ায় বেশ কয়েকটি মুংডি নুডলসের দোকানে বিকেল থেকে রাত অবধি ভিড় লেগেই থাকে। অথেনটিক মুংডি খেতে পর্যটকেরাও এই পাড়ায় একবার ঢুঁ মারেন।
বান্দরবানের উজানিপাড়া আর মারমাবাজারে এক সময় ঐতিহ্যবাহী ঘরোয়া পরিবেশে মুংডি বিক্রি হতো। গনগনে চুলার ওপর মুংডির হাঁড়ির চারপাশে গোল হয়ে বসতেন খদ্দররা। চুলা থেকে গরম মুংডি নিয়ে তাতে নানা উপাদান নিয়ে পরিবেশন করা হতো। তবে এখনকার মুংডির দোকানগুলো অনেকটা চাইনিজ রেস্তোরাঁ বা কফি শপের আদল পেয়েছে। শহরের উজানিপাড়া, মধ্যমপাড়া, বালাঘাটা, কালাঘাটা এমন বেশ কিছু মুংডি নুডলসের দোকান রয়েছে। বিকেল সেখানে বসে জমজমাট আড্ডা। স্থানীয় লোকজনের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি পর্যটকদের ভিড়ে মুখর হয়ে ওঠে মুংডি শপগুলো।
মুংডি মূলত মারমাদের জনপ্রিয় খাবার। এর উৎপত্তি মিয়ানমারে। বান্দরবান শহরের মুংডির দোকানগুলোও মারমরাই পরিচালনা করেন। মুহ হাং মুংডি শপের মালিক জসাই মারমার কাছে এ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মারমাদের ঐতিহ্যবাহী মুংডি এখন সবার কাছে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
চাল থেকে মুংডি করা হয়। পরিষ্কার চাল কয়েক দিন ভিজিয়ে রেখে পিষিয়ে মণ্ড করা হয়। ওই মণ্ড ফোটানো গরম পানিতে সেদ্ধ করার পর এক ধরনের চালুনিতে চাপ দিলে সুতার মতো লম্বা হয়ে বের হয়ে আসে। এরপর সেগুলো গরম পানিতে সেদ্ধ করে তেল, গোলমরিচ ও চিংড়ি শুঁটকির গুঁড়াসহ বিভিন্ন উপকরণ মিশিয়ে পরিবেশ হয়ে থাকে। বর্তমানে সনাতন পদ্ধতিতে তৈরি মুংডির পাশাপাশি মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের কারখানার মুংডিও পাওয়া যায়। তবে সনাতন পদ্ধতির মুংডির স্বাদই সবচেয়ে ভালো।
টক-ঝাল মুন্ডি সাধারণ নুডলসের মতো নয়। বান্দরবানের মারমা সম্প্রদায়ের লোকজন অতীতকাল থেকে এই খাবার খেতে অভ্যস্ত। তবে এখন বাঙালিরাও এই খাবার পছন্দ করছেন। বেসরকারি ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির (আইইউবি) ভাষাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী তাহিয়া তাহসিন, নাহিয়া বিনতে নাসির, ফারিয়া বাসেরসহ ১২ জনের একটি দল গবেষণার কাজে এসেছেন বান্দরবানে। উজানীপাড়া বংড মুংডি শপে তাঁদের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা বললেন, এসে স্থানীয় বিশেষ খাবার খুঁজছিলেন। পরিচিত এক বন্ধু মুংডি শপে নিয়ে আসেন। চালের তৈরি হলেও মুংডি অসাধারণ একটি খাবার। এ জন্য বিকেলে কাজ শেষে তাঁরা সবাই মুংডি খেতে আসেন। মুংডির সঙ্গে চিংড়ি শুঁটকির মণ্ড, কয়লায় সেদ্ধ কাবাব খাওয়া হয়। এই খাবারে কৃত্রিমতা বলতে কিছুই নেই।
ঢাকা থেকে আমিনুল কবির নামের একজন বলেছেন প্রত্যেক অঞ্চলে নিজস্ব বা ব্র্যান্ডিং খাবার বা অন্য কিছু থাকে। মুংডি হলো সে রকমই বান্দরবানের ব্র্যান্ডিং খাবার। মুংডি মানে বান্দরবান, বান্দরবানের খাবার মানে মুংডি। তাঁর মতে মুংডি হচ্ছে সাংস্কৃতিক খাদ্য। তরুণ-তরুণী ও সাংস্কৃতিক চেতনাসম্পন্ন মানুষেরা বেশি খায় এবং আড্ডা দেয়। এটি বেরসিক মানুষেরা খায় না।
বান্দরবানের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের সাংস্কৃতিক কর্মকর্তা চ খুই প্রু মারমা বলেছেন মুংডি মারমা ও রাখাইন প্রাচীন ঐতিহ্যের একধরনের পিঠা। তবে রাখাইন ও বান্দরবানের মারমাদের মুংডির মধ্যে স্বাদে পার্থক্য রয়েছে। মূলত মুংতি থেকে মুংডি হয়েছে। মুং অর্থ পিঠা, তি মানে কেঁচো।
দেখতে কেঁচোর মতো বলে মুংডি বলা হয়ে থাকে। তবে মুংডি একধরনের পিঠা হলেও পিঠার চেয়ে বেশি দল বেঁধে দল খাওয়ার মধ্যে সৌজন্য ও সৌহার্দ্যের আত্মিক বন্ধন বলা যেতে পারে।