চ্যংরাউ ম্রো ও তার চার ভাই-বোন। গত বান্দরবানের চিম্বুক-থানচি সড়কের পাশে রাংলাই হেডম্যান পাড়ায়
চ্যংরাউ ম্রো ও তার চার ভাই-বোন। গত বান্দরবানের চিম্বুক-থানচি সড়কের পাশে রাংলাই হেডম্যান পাড়ায়

দুই মাসের ব্যবধানে হারিয়েছে মা–বাবা, অকূলপাথারে পাঁচ ভাইবোন

চ্যংরাউ ম্রো কিছু বলে না, চুপচাপ শুধু কাঁদে। চোখের সামনে মা বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গেছেন গত রোববার। এর মাত্র দুই মাস আগে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে বাবার। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় ১৩ বছরের চ্যংরাউ। সবচেয়ে ছোট বোনটির বয়স মাত্র দেড় বছর। দুই মাসের ব্যবধানে মা-বাবার মৃত্যুতে অসহায় হয়ে পড়েছে তারা।

চ্যংরাউ ম্রোদের বাড়ি বান্দরবানের চিম্বুক-থানচি সড়কের পাশে রাংলাই হেডম্যানপাড়ায়। গতকাল মঙ্গলবার পাড়াটিতে গিয়ে দেখা যায়, অনাথ এই শিশুদের ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন পাড়ার বাসিন্দারা। সবার চোখেমুখে উদ্বেগ। কেউ কোনো কথা বলছেন না। হঠাৎ ভেসে এল কান্নার শব্দ। দেড় বছরের পাওপ্রে ম্রো মায়ের খোঁজে একজনের কাছ থেকে আরেকজনের কোলে যাচ্ছে। মাকে না পেয়ে কান্নাকাটি করছে সে।

বিদ্যুৎস্পৃষ্টের ঘটনাটি ঘটে গত রোববার গভীর রাতে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ওই এলাকার একটি বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার আগুনে পুড়ে যায়। এ সময় বিভিন্ন ঘরে থাকা বিদ্যুৎ সংযোগে স্ফুলিঙ্গ দেখা দেয়। তখন ঘরের বাতি-ফ্যানের সুইচ বন্ধ করতে গিয়ে পৃথকভাবে তিনজন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে নিহত হন। আহত হয় সাতটি শিশু। নিহত সবারই গতকাল দুপুরে ওই এলাকার একটি পাহাড়ি ঢালে সৎকার করা হয়েছে। নিহত তিনজনের একজন ছিলেন রিয়েন ম্রো। তিনিই চ্যংরাউ ম্রোর মা। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে চ্যংরাউয়ের চার বছর বয়সী বোন চংথুইও আহত হয়েছে।

বিদ্যুৎস্পৃষ্টের ঘটনাটি ঘটে গত রোববার গভীর রাতে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ওই এলাকার একটি বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার আগুনে পুড়ে যায়। এ সময় বিভিন্ন ঘরে থাকা বিদ্যুৎ সংযোগে স্ফুলিঙ্গ দেখা দেয়। তখন ঘরের বাতি-ফ্যানের সুইচ বন্ধ করতে গিয়ে পৃথকভাবে তিনজন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে নিহত হন। আহত হয় সাতটি শিশু।

সরেজমিন দেখা যায়, চংথুই ম্রোর হাতে এখনো পোড়া দাগ। ছয় বছরের চ্যংরেং ও দশ বছরের সাইরাম ম্রোও চুপচাপ। কেউ কেউ এসে তাদের কাছ মায়ের সম্পর্কে জানতে চাচ্ছে। কোনো উত্তর না দিয়েই তারা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকছে আর চোখ মুছছে।

শিশুদের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিবেশী রুইতন ম্রো প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুই মাস আগে বাবা মরেছে। এই শোকই পরিবারটির কাটেনি। এখন আবার মায়ের মৃত্যু দেখল শিশুগুলো। এই আঘাত কীভাবে তারা কাটিয়ে উঠবে। তাদের ভবিষ্যৎই–বা কী হবে।’

গত রোববার রাতে এই ঘরেই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু হয় রিয়েন ম্রো। গতকাল তোলা

স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চ্যংরাউ ম্রোর বাবা মেনরাও মারা যাওয়ার পর থেকে মা রিয়েন ম্রো সবজি চাষ আর পাহাড়ি ফল বিক্রি করে সংসার চালিয়ে আসছিলেন। ঘরে ৭৫ বছর বয়সী বৃদ্ধ দাদি আর ৪৫ বছর বয়সী প্রতিবন্ধী পিসিও (ফুফু) রয়েছে।

‘দুই মাস আগে বাবা মরেছে। এই শোকই পরিবারটির কাটেনি। এখন আবার মায়ের মৃত্যু দেখল শিশুগুলো। এই আঘাত কীভাবে তারা কাটিয়ে উঠবে। তাদের ভবিষ্যৎই–বা কী হবে।’
রুইতন ম্রো, প্রতিবেশী

চ্যংরাউ রাঙামাটির মোনোঘর আবাসিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াশোনা করত। বাবার মৃত্যুর পর বিদ্যালয়ে আর ফিরে যাওয়া হয়নি তার। পাড়ার প্রবীণ পাতুই ম্রো বলেন, রিয়েন ম্রোর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পুরো পরিবারটিই অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। পরিবারটিকে দেখভালের মতো কেউ রইল না।

রেনিক্ষ্যং মৌজার হেডম্যান রাংলাই ম্রো প্রথম আলোকে বলেন, ‘জেলা পরিষদে আবেদন করব, যাতে এসব অনাথ শিশু-কিশোরের ভবিষ্যতের ব্যবস্থা করা যায়। চার ও দেড় বছরের দুই শিশুর ভরণপোষণ দরকার। আর অন্যদের কোনো আবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জায়গা করে দিতে হবে।’