বাড়ির উঠানে উচ্ছ্বসিত এভারেস্টজয়ী শাকিলের মা শিরিনা বেগম। গতকাল সোমবার বিকেলে গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার ফুলবাড়িয়া ইউনিয়নের বাগচালা গ্রামে
বাড়ির উঠানে উচ্ছ্বসিত এভারেস্টজয়ী শাকিলের মা শিরিনা বেগম। গতকাল সোমবার বিকেলে গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার ফুলবাড়িয়া ইউনিয়নের বাগচালা গ্রামে

শাকিলের এভারেস্ট জয়ে আবেগাপ্লুত কিষানি মা, উচ্ছ্বসিত এলাকাবাসী

পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্টে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ালেন ইকরামুল হাসান শাকিল। এ খবরে আনন্দের বন্যা বইছে গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার ফুলবাড়িয়া ইউনিয়নের বাগচালা গ্রামে। সেখানে সবার মুখে মুখে শাকিলের এভারেস্ট জয়ের গল্প। তাঁরা শাকিলের বাড়িতে উল্লাস প্রকাশ করছেন। সবার কাছ থেকে সন্তানের প্রশংসা পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে যাচ্ছেন তাঁর মা শিরিনা বেগম।

গত ২৫ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজার থেকে হেঁটে রওনা দিয়ে ১৯ মে নেপালের স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছান ইকরামুল হাসান। পরে গতকাল সোমবার বেলা ২টা ১০ মিনিটে ইকরামুল হাসানের ফেসবুক পেজে এক স্ট্যাটাসে তাঁর অভিযানের সমন্বয়কেরা জানান, ‘এইমাত্র খবর পেলাম, শাকিল সামিট করেছে এবং সুস্থ আছে। ক্যাম্প–৪–এ নেমে এসেছে। নেটওয়ার্ক না থাকায় বিস্তারিত তথ্য এখন দেওয়া যাচ্ছে না।’

কালিয়াকৈর সদর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে ফুলবাড়িয়া বাজার। ওই বাজার থেকে আরও চার কিলোমিটার গেলে বাগচালা গ্রামে ইকরামুল হাসানের (৩৫) বাড়ি। গতকাল বিকেলে সরেজমিনে দেখা যায়, বাড়িতে চারটি ঘর রয়েছে। এর মধ্যে একটি রান্নাঘর। সব কটিই মাটির তৈরি। আশপাশের লোকজন বাড়িতে ভিড় করছেন। ইকরামুলের মাকে ঘিরে ধরছেন। অনেকেই তাঁকে জড়িয়ে ধরে উল্লাস করছেন।

ইকরামুল হাসানের এভারেস্ট জয়ের খবরে বাড়িতে ভিড় করছেন শুভাকাঙ্ক্ষীরা। সোমবার বিকেলে গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার ফুলবাড়িয়া ইউনিয়নের বাগচালা গ্রামে

পরিবারের সদস্যরা জানান, ইকরামুল হাসান বাগচালা গ্রামের খবির উদ্দিনের ছেলে। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার বড়। ২০১৯ সালে খবির উদ্দিনের মৃত্যুর পর ছোট দুই ভাই সজীব আহম্মেদ (২৮) ও সাকিব আহম্মেদকে (২২) নিয়ে শুরু হয় সংগ্রামের জীবন। সংসার ও পড়াশোনার খরচ চালাতে সুপারশপে বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করেছেন। তাঁর কিষানি মা সব সময় পর্বতারোহণে অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছেন।

গত শুক্রবার ছেলের সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয় শিরিনা বেগমের। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুক্রবার ছেলে ফোন করে বলে, “মা, আমি এভারেস্টের চূড়ায় উঠতেছি, ভালো আছি, তোমরা চিন্তা কোরো না।” এর পর থেকে ছেলের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ নেই। রাতে ঘুম নেই। আজ সকালে খবর আসার কথা। কিন্তু আটটা বাইজা গেছে তারপরও কোনো খবর আহে না। চিকড়াপাকড়া পাড়তাছি (কান্নাকাটি করছি) কোনো খবর পাই না। পরে দুইটার সময় ঢাহা থাইকা ফোন আইছে যে শাকিল পাহাড়ের চূড়ায় উঠছে, সেখান থাইকা নামতাছে। খবর হুইনা (শুনে) আমি অনেক খুশি হইছি।’

মায়ের সাহসই ইকরামুল হাসানের এগিয়ে চলার প্রেরণা

ইকরামুলের এমন অর্জনে উচ্ছ্বসিত এলাকার লোকজনও। তাঁরা বলছেন, ইকরামুল একজন সংগ্রামী ছেলে। অদম্য ইচ্ছাশক্তির কারণে তিনি লক্ষ্যে পৌঁছেছেন। এই সংগ্রাম তাঁর দীর্ঘদিনের। এই অর্জনে শুধু এলাকাবাসী নয়, পুরো বাংলাদেশ গর্বিত। এটি বিশ্ব পর্বতারোহণ ইতিহাসেও এক অনন্য উদাহরণ। তাঁর এই প্রচেষ্টা আগামী দিনের পর্বত আরোহীদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।

ফুলবাড়িয়া এলাকার আক্কেল আলী উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আতাউর রহমান বলেন, ‘শাকিলের এই অর্জন আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। সে শুধু আমাদের এলাকার নয়, সারা দেশের সুনাম বয়ে নিয়ে এসেছে। সে যাওয়ার আগে আমার সঙ্গে, গ্রামের অনেকের সঙ্গে দেখে করে দোয়া নিয়ে গেছে।’

ইকরামুল হাসান তাঁর এই অভিযানের নাম দেন ‘সি টু সামিট’, অর্থাৎ সমুদ্র থেকে শৃঙ্গ। সে লক্ষ্যেই গত ২৫ ফেব্রুয়ারি দুপুরে কক্সবাজারের ইনানী সমুদ্রসৈকত থেকে এভারেস্টচূড়ার উদ্দেশে হাঁটা শুরু করেন। চট্টগ্রাম, ফেনী, কুমিল্লা ও মুন্সিগঞ্জ হয়ে ১২ দিন পর ঢাকায় পৌঁছান। কয়েক দিন বিরতি দিয়ে আবার হাঁটা শুরু করে গাজীপুর, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ হয়ে ২৮ মার্চ পৌঁছান পঞ্চগড়ে। ইকরামুল হাসান পরদিন বাংলাদেশ থেকে প্রবেশ করেন ভারতে। সে দেশের জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং হয়ে ৩১ মার্চ পা রাখেন নেপালে। এভাবে প্রায় ১ হাজার ৪০০ কিলোমিটার পথ হেঁটে গত ২৯ এপ্রিল এভারেস্ট বেজক্যাম্পে পৌঁছান ইকরামুল হাসান।

ইকরামুলের ছোট ভাই সাকিব আহম্মেদ বলেন, ‘আমার ভাইয়ের অর্জনে আমরা গর্বিত। ভাই তাঁর পরিশ্রমের ফল হাতে পেয়েছেন। আমরা সুস্থভাবে তাঁর ফিরে আসার অপেক্ষায় রয়েছি।’