চট্টগ্রাম জেলার আয়তন সব মিলিয়ে ৩ হাজার ২৮২ বর্গমাইল। এর মধ্যে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত এলাকার আয়তন ৬০ বর্গমাইলের মতো। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন—দুই সংস্থার হিসাবেই রয়েছে এমন তথ্য। তবে নগর বা সিটি করপোরেশন এলাকায় জনসংখ্যা কত, তা নিয়ে এ দুই সংস্থার হিসাবে রয়েছে বিশাল ব্যবধান। সিটি করপোরেশনের হিসাবে যে–সংখ্যক জনসংখ্যার কথা বলা হয়, তা পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবের প্রায় দ্বিগুণ।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, নগরে জনসংখ্যা আনুমানিক ৬০ লাখ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের জনশুমারি ও গৃহগণনার তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকার জনসংখ্যা ৩২ লাখ ৩০ হাজার ৫০৭।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের হিসাব অবশ্য কোনো জরিপের ভিত্তিতে করা হয়নি, অনুমানের ভিত্তিতেই করা। উত্তর দিকে লতিফপুর-জঙ্গল সলিমপুর; দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর ও কর্ণফুলী নদী; পূর্ব দিকে কর্ণফুলী নদী থেকে হালদা, চিকনদণ্ডী এবং পশ্চিম দিকে বঙ্গোপসাগর, ভাটিয়ারী ও জঙ্গল ভাটিয়ারী—কাগজে–কলমে এটিই চট্টগ্রাম নগরের সীমানা।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কোনো অঞ্চলে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের আগে সেখানে বসবাসকারী মানুষের প্রকৃত সংখ্যা নির্ভুলভাবে নির্ধারণ করা অত্যন্ত জরুরি। কারণ, জনসংখ্যার সঠিক হিসাব না থাকলে প্রকল্প–পরিকল্পনা, বাজেট নির্ধারণ, অবকাঠামোর আকার, সেবাদানের সক্ষমতা—সবকিছুতেই ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঝুঁকি থাকে। এতে সরকারি সম্পদের অপচয় হয় এবং জনগণ প্রত্যাশিত সেবা পায় না।
নথিপত্রে জনসংখ্যার হিসাব
২০২২ সালের জনশুমারি ও গৃহগণনা অনুযায়ী, চট্টগ্রাম জেলার জনসংখ্যা ৯১ লাখ ৭৯ হাজার ৪৬৫। এর মধ্যে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এবং ১৫টি উপজেলা এলাকা রয়েছে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ২০২০-২১ অর্থবছরের বার্ষিক প্রশাসনিক প্রতিবেদনে জনসংখ্যা দেখানো হয় আনুমানিক ৬০ লাখ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বার্ষিক প্রশাসনিক প্রতিবেদনে জনসংখ্যা বলা হয় আনুমানিক ৭০ লাখ। অর্থাৎ করপোরেশন বলছে, ৩ বছরে জনসংখ্যা ১০ লাখ বেড়েছে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ২০২০-২১ অর্থবছরের বার্ষিক প্রশাসনিক প্রতিবেদনে জনসংখ্যা দেখানো হয় আনুমানিক ৬০ লাখ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বার্ষিক প্রশাসনিক প্রতিবেদনে জনসংখ্যা বলা হয় আনুমানিক ৭০ লাখ। অর্থাৎ করপোরেশন বলছে, ৩ বছরে জনসংখ্যা ১০ লাখ বেড়েছে।
নগরে ৭০ লাখের মতো জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় ১৫ লাখ ভাসমান; তাদের ভাসমান বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও ২০২৪ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ১৯ লাখ ৫১ হাজার ৫২ জন।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন তাদের ওয়েবসাইটে উল্লেখ করেছে, মাত্র ৬ বর্গমাইল আয়তন নিয়ে ১৮৬৩ সালে যাত্রা শুরু করে চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালটি। ১৯৮২ সালে পৌরসভাকে চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনে উন্নীত করা হয়। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নামে যাত্রা শুরু হয় ১৯৯০ সালে। কর্মকর্তারা বলছেন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন হিসেবে যাত্রা শুরুর সময় জনসংখ্যা ছিল ২০ লাখ। যদিও বিবিএসের হিসাবে ১৯৯১ সালে সিটি করপোরেশনে জনসংখ্যা ১৩ লাখ ৬৬ হাজার।
‘মেয়রই কমিটির প্রধান’
বিবিএসের কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা গেছে, জনশুমারির সময় জেলা, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা ইত্যাদি পর্যায়ে কমিটি হয়। এসব কমিটির প্রধান থাকেন জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী, পৌর ও সিটি মেয়র। কোনো এলাকার জরিপ শেষে কমিটি সেটি অনুমোদন দিয়ে থাকে। অর্থাৎ সিটি করপোরেশন এলাকায় পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ মেয়রই অনুমোদন দিয়েছেন।
নগরের বাসিন্দা ৭০ লাখ হলে প্রতি বর্গকিলোমিটার এলাকায় জনসংখ্যা ৪৩ হাজারের বেশি। এটির পক্ষে সিটি করপোরেশনের কোনো পরিসংখ্যান আছে কি না, আমার জানা নেই। অথচ যে কমিটি নগর এলাকায় পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপের অনুমোদন করে, সিটি মেয়রই সেটির প্রধান।মোহাম্মদ ওয়াহিদুর রহমান, চট্টগ্রাম বিভাগীয় যুগ্ম পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত), বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো।
বিবিএসের চট্টগ্রাম বিভাগীয় যুগ্ম পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ ওয়াহিদুর রহমান বলেন, ‘পাহাড়, সমুদ্রঘেরা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আয়তন আমরা হিসাব করি ১৬১ বর্গকিলোমিটার (৬২ বর্গমাইল) এলাকা। নগরের বাসিন্দা ৭০ লাখ হলে প্রতি বর্গকিলোমিটার এলাকায় জনসংখ্যা ৪৩ হাজারের বেশি। এটির পক্ষে সিটি করপোরেশনের কোনো পরিসংখ্যান আছে কি না, আমার জানা নেই। অথচ যে কমিটি নগর এলাকায় পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপের অনুমোদন করে, সিটি মেয়রই সেটির প্রধান।’
২০২২ সালে জনশুমারির সময় সিটি মেয়র হিসেবে দায়িত্ব ছিলেন মো. রেজাউল করিম চৌধুরী। গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে তিনি আত্মগোপনে আছেন। ফলে তাঁর বক্তব্য জানা যায়নি। বক্তব্য জানতে বর্তমান সিটি মেয়র শাহাদাত হোসেনের মুঠোফোনে যোগাযোগ করে তাঁকে পাওয়া যায়নি। করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, মেয়র শুধু বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান। তথ্যের সত্যতা যাচাই মেয়রের দায়িত্ব নয়।
সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আশরাফুল আমিন বলেন, ইপিআই টিকা আনার সময় দেখা যায়, বিবিএসের দেওয়া হিসাবের পর আরও ১০ শতাংশের মতো অতিরিক্ত টিকা আনতে হয়। বিবিএসের হিসাব এ ক্ষেত্রে মেলে না। আবার বিভিন্ন ত্রাণ দেওয়ার সময়ও বেশি জনসংখ্যা দেখা যায়।
দুই সংস্থাই জনসংখ্যার সঠিক হিসাব দেয় না বলে মন্তব্য করেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন), চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবীর চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আমার নিজের ঘরের তথ্যই বিবিএস নেয়নি। সিটি করপোরেশনেরও তাদের সুবিধার্থে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তথ্য দেয়। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্য নিয়ে দুই সংস্থার এমন তথ্য আসলেই দুঃখজনক।’