হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসা রোগীদের ভিড়
হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসা রোগীদের ভিড়

বাহুবল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স

চিকিৎসক মাত্র ৩ জন, অন্তঃসত্ত্বাদের সেবায় নার্স, দাঁতের চিকিৎসায় টেকনোলজিস্ট

হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার দিঘিরপাড় গ্রামের কিশোরী ইয়াসমিন আখতার (১৫) পেটে ব্যথা নিয়ে রোববার দুপুরে বাহুবল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসে। জরুরি বিভাগের স্বাস্থ্য সহকারীরা রোগীর শয্যায় তাঁকে শুইয়ে রাখেন। কিছু সময় পর জরুরি বিভাগের দায়িত্বরত চিকিৎসক তাকে পরীক্ষা করে হাসপাতালে ভর্তি করেন।

এভাবে প্রতিদিন তিনজন চিকিৎসক, চার থেকে পাঁচজন স্বাস্থ্য সহকারী ও মেডিকেল টেকনোলজিস্ট দিয়ে বাহুবল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২৫০ থেকে ৩০০ মানুষের চিকিৎসা চালাতে হচ্ছে। এ উপজেলায় প্রায় আড়াই লাখ মানুষের বসবাস।

হাসপাতালে গিয়ে পাওয়া গেল চিকিৎসক আলমগীর হোসেনকে। তিনি হাসপাতালের ১০ নম্বর কক্ষে বসেন। এ কক্ষের সামনে রোগীদের ভিড় দেখা গেল বেশি। তিনি বলেন, ‘চিকিৎসক সংকটের কারণে রোগীর চাপ একটু বেশি। এত সব রোগী সামলাতে বেশ হিমশিম খেতে হয়। এ ছাড়া বাহুবল দাঙ্গাপ্রবণ এলাকা। হঠাৎ ঝগড়া করে একসঙ্গে ঝাঁকে ঝাঁকে লোকজন চলে আসেন। যতটুকু সম্ভব এর মধ্যেই রোগীদের ভালো সেবা দেওয়ার চেষ্টা করি।’ তিনি জানান, জরুরি বিভাগের দায়িত্ব, বহির্বিভাগের দায়িত্ব, আবাসিক বিভাগের দায়িত্বসহ মোট ৫টি পদে তাঁকে একাই কাজ করতে হচ্ছে। হবিগঞ্জ সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে প্রেষণে তাঁকে এখানে পাঠানো হয়েছে।

শুক্র-শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় রোববার অন্যান্য দিনের তুলনায় বাহুবল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগীর চাপ অনেক বেশি ছিল। সরেজমিনে দেখা যায়, হাসপাতালের টিকিট কাউন্টারে রোগীদের দীর্ঘ সারি। কাউন্টারের টিকিট বিক্রেতা রোগের ধরন অনুযায়ী রোগীদের বিভিন্ন কক্ষে চিকিৎসকদের কাছে পাঠাচ্ছেন।
জরুরি বিভাগ সামলাচ্ছেন একজন চিকিৎসক এবং দুই থেকে তিনজন স্বাস্থ্য সহকারী। তাঁরা রোগীদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসাপত্র দিচ্ছেন। এ ব্যাপারে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ বলছে, চিকিৎসকের সংকটের কারণে কমিউনিটি চিকিৎসা কর্মকর্তা দিয়ে জরুরি বিভাগের কার্যক্রম চালাতে হচ্ছে। চিকিৎসকদের ১৭টি পদের মধ্যে ১৪টিই শূন্য। শিশুদের জন্য জুনিয়র কনসালট্যান্ট আছেন মাত্র একজন। গাইনি বিভাগের কোনো চিকিৎসক না থাকায় একজন জ্যেষ্ঠ নার্স দিয়ে অন্তঃসত্ত্বা নারীদের চিকিৎসা দিতে হচ্ছে।

বেশ কয়েকজন রোগীর সঙ্গে চিকিৎসা নিয়ে কথা হলে তাঁদের অধিকাংশই বাহুবল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসাসেবায় সন্তুষ্টির কথা জানালেন

ভবনের ভেতরেই হাসপাতালের ফার্মেসি। চিকিৎসকেরা রোগীদের যে ওষুধ লিখে দিচ্ছেন, তার কিছু অংশ বিতরণ করা হচ্ছে। আর যে ধরনের ওষুধ হাসপাতালের তালিকায় নেই, তা বাইরে থেকে কিনতে পরামর্শ দেওয়া হয়।

হাসপাতালের নিচতলার ১৬ নম্বর কক্ষের সামনে দেখা গেল নারীদের দীর্ঘ সারি। গাইনি চিকিৎসক না থাকায় তাঁদের চিকিৎসা দিচ্ছিলেন জ্যেষ্ঠ নার্স রোকসানা খাতুন। তাঁকে বেশ হিমশিম খেতে হচ্ছে এত রোগী একসঙ্গে সামাল দিতে। এ সময় কথা হয় উপজেলার অলুয়া গ্রামের রাশেদা আক্তারের (২২) সঙ্গে। তিনি সকাল ১০টায় এসেছেন। কথা বলার সময় ঘড়িতে দুপুর সাড়ে ১২টা বাজে। এখনো চিকিৎসা নিতে পারেননি। তিনি বলেন, একজন অন্তঃসত্ত্বার এত সময় ধরে অপেক্ষা করা বেশ কষ্টকর। শরীরও ভালো যাচ্ছে না।

সকাল থেকে বহির্বিভাগে তিন শতাধিক রোগী অবস্থান করছিলেন। এ সময় বহির্বিভাগের রোগীদের চিকিৎসা কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন ও জুনিয়র কনসালট্যান্ট (শিশু) রুবনা ফারজানা চিকিৎসা দিচ্ছিলেন।

১৭ নম্বর কক্ষটি সহকারী সার্জন মিজানুর রহমানের। এ কক্ষের সামনে ২০ থেকে ২২ জন রোগী অপেক্ষা করছিলেন চিকিৎসকের জন্য। কথা হয় উপজেলার লামাতাশি গ্রামের ফিরোজ আলীর (৬০) সঙ্গে। তিনি বলেন, সকাল সাড়ে ১০টায় তিনি আসেন। এখন বেলা একটা বাজতে চলেছে। কিন্তু চিকিৎসকের দেখা পাননি তিনি।

হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসা রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছেন চিকিৎসক আলমগীর হোসেন

১৪ নম্বর কক্ষে দন্তচিকিৎসা দিতে দেখা গেল ডেন্টাল টেকনোলজিস্ট শ্যামলী দেবীকে। তিনি বলেন, এ হাসপাতালে দন্তচিকিৎসক পদে কোনো চিকিৎসক নেই। তিনি ২০০৭ সাল থেকে এ দায়িত্ব পালন করে আসছেন। প্রথম দিকে চিকিৎসা দেওয়ার মতো কিছুই ছিল না এ হাসপাতালে। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর কিছু সরঞ্জাম আনা হয়েছে। অন্তত প্রাথমিক চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার মতো পরিবেশ হয়েছে।

হাসপাতালের নারী, শিশু ও পুরুষ ওয়ার্ডে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রোগী ভর্তি আছেন ২৩ জন। জরুরি বিভাগে নতুন করে ভর্তির জন্য অপেক্ষা করছেন আরও চার থেকে পাঁচজন। তবে হাসপাতালের প্রতিটি ওয়ার্ড বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দেখা গেল। বিশেষ করে শৌচাগার পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা প্রতিদিন দুবার পরিষ্কার করেন। উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আবদুল্লাহ হেল মারুফ ফারকী সব সময় হাসপাতালের ওয়ার্ড পরিদর্শন করেন বলে জানালেন দায়িত্বরত ব্যক্তিরা। তবে ওই দিন তাঁকে কর্মস্থলে পাওয়া যায়নি।

গাইনি বিভাগের কোনো চিকিৎসক না থাকায় একজন জ্যেষ্ঠ নার্স দিয়ে অন্তঃসত্ত্বা নারীদের চিকিৎসাসেবা দিতে হচ্ছে

হাসপাতালের ভেতরে রোগীদের বসার আলাদা জায়গা আছে। এখানে রোগীদের অনেকেই বসা। কেউ চিকিৎসা নিতে এসেছেন, আবার কেউ কেউ চিকিৎসা নিয়ে একটু বিশ্রাম নিচ্ছেন। বেশ কয়েকজন রোগীর সঙ্গে চিকিৎসা নিয়ে কথা হলে তাঁদের অধিকাংশই সন্তুষ্টির কথা জানালেন।

এ বিষয়ে কথা বলতে বাহুবল উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আবদুল্লাহ হেল মারুফ ফারকীর মুঠোফোনে বেশ কয়েকবার কল করলেও তিনি ধরেননি। পরে খুদে বার্তা পাঠালেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।