ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে অসংখ্য বাঁক থাকায় প্রতিনিয়তই ঘটছে দুর্ঘটনা। শুক্রবার ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার কামারখালী এলাকায়
ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে অসংখ্য বাঁক থাকায় প্রতিনিয়তই ঘটছে দুর্ঘটনা। শুক্রবার ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার কামারখালী এলাকায়

ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক

ঘন ঘন বাঁক, চলে অবৈধ যান

এক বছরে দুর্ঘটনায় ৫৫ জন নিহত। দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ মহাসড়কে রিকশা, ভ্যান, ইজিবাইকসহ স্বল্পগতির অবৈধ তিন চাকার যান চলাচল। 

ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের ফরিদপুরের কামারখালী সেতু থেকে রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ফেরিঘাট পর্যন্ত ৭৩ কিলোমিটারে গত এক বছরে ৫৭টি দুর্ঘটনায় অন্তত ৫৫ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার ফরিদপুরের কানাইপুরে বাস-ট্রাকের সংঘর্ষে নারী-শিশুসহ ১৫ জন নিহত হয়েছেন। ঘন ঘন বাঁক, অপরিকল্পিত গতিরোধক, বিভিন্ন জায়গায় রাস্তা উঁচু-নিচু (রাটিং) হয়ে যাওয়া, মহাসড়কে অবাধে তিন চাকার যান চলাচলসহ নানা কারণে দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে।

পরিবহন-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মহাসড়কে অবৈধ তিন চাকার যান চলাচল বন্ধ, মোটরসাইকেলের জন্য আলাদা লেন ও সড়ক টেকসইভাবে মেরামত করতে পারলে ৮০ শতাংশ দুর্ঘটনা কমে যাবে। একই সঙ্গে যাত্রী ও পথচারীদের সচেতন হতে হবে। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ভাষ্য, সম্প্রতি ফরিদপুরে দুর্ঘটনায় তাঁরা নড়েচড়ে বসেছেন। মহাসড়কে অবৈধ ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল বন্ধে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়েছেন। প্রয়োজনে চিকিৎসকসহ অভিযান চালাবেন। অন্যদিকে মহাসড়ক সংস্কারের জন্য বরাদ্দ চেয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ)।

সওজ ও হাইওয়ে পুলিশ সূত্র জানায়, ফরিদপুর ও রাজবাড়ীর চারটি উপজেলা দিয়ে যাওয়া মহাসড়কের ৪০ কিলোমিটার কামারখালী সেতু থেকে শহরের রাজবাড়ী মোড় পর্যন্ত এবং ৩৩ কিলোমিটার পড়েছে রাজবাড়ী মোড় থেকে দৌলতদিয়া ঘাট পর্যন্ত । ২০২৩ সালের মার্চ থেকে চলতি বছরের ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত এ মহাসড়কে ৫৭টি দুর্ঘটনার তথ্য রেকর্ড করেছে হাইওয়ে পুলিশ। এতে ৫৫ জন নিহত ও ৭৮ জন আহত হয়েছেন। দুর্ঘটনাজনিত মামলা হয়েছে ৩৭টি এবং সাধারণ ডায়েরি হয়েছে ২০টি। সর্বশেষ ১৬ এপ্রিল ফরিদপুর সদরের কানাইপুরে ১৫ জন নিহত হন। গত তিন বছরে ফরিদপুরে এত বড় দুর্ঘটনা আর ঘটেনি।

৭৩ কিলোমিটারে ২৩ বাঁক

সরেজমিন ঘুরে ও দুর্ঘটনার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মহাসড়কের এ অংশে ঘন ঘন বাঁক ও অপরিকল্পিত গতিরোধক দুর্ঘটনার অন্যতম একটি কারণ। গত শনিবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কামারখালী সেতু থেকে দৌলতদিয়া পর্যন্ত ঘুরে ৭৩ কিলোমিটারে ২৩টি বাঁক পাওয়া গেছে। এর মধ্যে কামারখালী অংশে ১৬টি ও দৌলতদিয়া অংশে সাতটি।

কামারখালী অংশে সদরের ডোমরাকান্দি, গঙ্গাবর্দী, কানাইপুর বিসিক, করিমপুর হোসেন ফিলিং স্টেশন, মল্লিকপুর সেতু, মধুখালী উপজেলার মাঝকান্দি, দিঘুলিয়া, বোয়ালিয়া, নওপাড়ামোড়ের বাঁকগুলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ দেখা যায়। অন্যদিকে দৌলতদিয়া অংশে সদরের বাহিরদিয়া, চন্ডিপুর, রাজবাড়ী সদরের নিমতলা, খানকপাট ও গোয়ালন্দের মুকুলের দোকান এলাকার বাঁক ঝুঁকিপূর্ণ।

অপরিকল্পিত গতিরোধক

মহাসড়কে গতিরোধক না বসাতে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা আছে। এরপরও মহাসড়কের বিভিন্ন স্কুল ও রেলক্রসিংয়ের সামনে মানুষের নিরাপত্তার কথা ভেবে গতিরোধক বসানো হয়েছে। ৭৩ কিলোমিটার সড়কে ঠিক কতটি গতিরোধক আছে, সেই তথ্য দিতে পারেনি সওজ। তবে সওজ নির্ধারিত গতিরোধকের বাইরে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বাড়ি, হাটবাজারের সামনে অনেকে স্থানীয়ভাবে গতিরোধক বসিয়েছেন। এসব অপরিকল্পিত গতিরোধকের কারণে অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটে। সরেজমিনে মধুখালীর নওপাড়া, সদরের বদরপুর এলাকায় ২টিসহ অন্তত ১২টি এমন গতিরোধক পাওয়া গেছে।

সদর উপজেলার কোমরপুর এলাকার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন, বদরপুর এলাকায় সাবেক মন্ত্রীর বাড়ির সামনে দুটি গতিরোধক আছে। সেখানে প্রায়ই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটে। মাসখানেক আগে তিনি নিজে দুর্ঘটনায় পড়েছেন।

ফরিদপুর সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী ইমরান ফারহান বলেন, মহাসড়কে গতিরোধক না করার নির্দেশনা আছে হাইকোর্টের। আগে শতাধিক গতিরোধক ছিল। ধীরে ধীরে কমিয়ে আনা হয়েছে। বেশ কয়েকটি অপ্রয়োজনীয় গতিরোধক আছে স্বীকার করে তিনি বলেন, পর্যায়ক্রমে সেগুলো অপসারণ করা হবে।

মহাসড়কে ‘রাটিং’

ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের ফরিদপুর অংশের ৪০ কিলোমিটারের বিভিন্ন অংশ ফেটে গেছে এবং সড়কে উঁচু-নিচু ঢেউ তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে সদরের গঙ্গাবর্দী থেকে কানাইপুর, মধুখালীর মাঝকান্দি থেকে মধুখালী পৌরসভাসহ অন্তত ২৫ কিলোমিটারের অবস্থা বেশি খারাপ। অন্যদিকে দৌলতদিয়া অংশের সড়ক ফরিদপুরের তুলনায় ভালো। যদিও রাজবাড়ী মোড় থেকে বাহিরদিয়া সেতু পর্যন্ত কিছু অংশে খানাখন্দ আছে।

ফরিদপুর-কামারখালী পথে নিয়মিত বাস চালান শহরের গোয়ালচামট মহল্লার বাসিন্দা ফজলু শেখ। তিনি বলেন, সড়কের কোথাও ভালো, আবার কোথাও খারাপ। অনেক বাঁক আছে। এ ছাড়া মহাসড়কে অবাধে নসিমন, করিমন, ইজিবাইক চলছে। সব সময় মাথা ঠান্ডা করে গাড়ি চালাতে হয়। একটু অসতর্ক হলেই বিপদ দেখা দেয়।

প্রকৌশলী ইমরান ফারহান বলেন, সড়কটি ১৯৯৬ সালে বানানো। এ সংস্কার করা প্রয়োজন। দুই বছর আগে ডিবিএসটি (ডাবল বিটুমিনাস সাবজেক্ট ট্রিটমেন্ট) করা হয়েছে। এখন দুই থেকে তিন ইঞ্চি পুরু প্রলেপ দেওয়া প্রয়োজন। তবে যেখানে ফেটে গেছে, সেখানে ডিবিএসটি করতে হবে। এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। আগামী অর্থবছরে কাজে হাত দেওয়া সম্ভব হবে।

অবৈধ যান ও যত্রতত্র পার্কিং

দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ মহাসড়কে রিকশা, ভ্যান, ইজিবাইকসহ স্বল্পগতির অবৈধ তিন চাকার যান চলাচল। পুরো মহাসড়কে অবৈধ যান চলাচল করতে দেখা গেছে। তবে মধুখালীর মাঝকান্দি থেকে মধুখালী বাজারসহ আড়পাড়া পর্যন্ত এসব যানবাহনের দাপট বেশি। পাশাপাশি দূরপাল্লার বাসগুলোর একটি অন্যটিকে ওভারটেক করা, সড়কের পাশে হাটবাজার, যত্রতত্র গাড়ি থামিয়ে যাত্রী ওঠানামার কারণেও দুর্ঘটনা ঘটছে।

বাসচালক আনোয়ার হোসেন বলেন, সড়কের পাশে হাটবাজার, অবৈধ যানবাহন, মোটরসাইকেলের বেপরোয়া গতি, সড়কের ত্রুটির জন্য দুর্ঘটনা বাড়ছে। যাত্রীদের দ্রুত পৌঁছে দেওয়ার তাড়া তো আছেই। একটি বাস অন্যটিকে ওভারটেক করলে যাত্রীরা চিৎকার শুরু করেন।

ফরিদপুর মোটর শ্রমিক ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি জোবায়ের জাকির বলেন, মহাসড়কে নছিমন-করিমনসহ অবৈধ যান চলাচল বন্ধ করা গেলে সড়ক দুর্ঘটনা ৮০ শতাংশ কমে যাবে। দুর্ঘটনার আরেকটি বড় কারণ, বেপরোয়া গতির মোটরসাইকেল। তাদের জন্য আলাদা লেন করা গেলে দুর্ঘটনা কমে যাবে।

নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন

ফরিদপুরে সম্প্রতি ১৫ জন নিহতের পর জেলা সড়ক নিরাপত্তা কমিটির সভায় ফরিদপুরের মহাসড়কে অবৈধ তিন চাকার যান ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালালে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

জেলা প্রশাসক কামরুল আহসান তালুকদার বলেন, এক সপ্তাহ পর জেলার অধীন কোনো মহাসড়কে থ্রি-হুইলার চলতে দেওয়া হবে না। মহাসড়কে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে। সেই দলে চিকিৎসকেরাও থাকবেন। তাঁরা চালকদের ডোপ টেস্ট, ডায়াবেটিস ও প্রেশার পরীক্ষা করে দেখবেন। এ ছাড়া গাড়ির ফিটনেস ও চালকের লাইসেন্স পরীক্ষা করা হবে। ফিটনেস ছাড়া গাড়ি ও লাইসেন্স ছাড়া কোনো চালক মহাসড়কে উঠতে পারবেন না। অন্যথায় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

মাদারীপুর হাইওয়ে পুলিশ সুপার শাহীনুর আলম খান বলেন, ‘বড় দুর্ঘটনা ঘটলে আমরা নড়েচড়ে বসি। নিজের দায় অন্যের ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করি। কিন্তু এ দায় প্রশাসন, বিআরটিএ, চালক-মালিক-শ্রমিকসহ সবার। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, কয়েক দিন পর আমরা হয়তো ভুলে যাব। তবে আমরা ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে চাই।’