ফেরিঘাটের ইজারা নিয়ে বিএনপির দুই পক্ষের দ্বন্দ্বের জের ধরে চাঁদপুর–শরীয়তপুর সড়কে যানবাহন আটকে দেওয়া হয়েছে। শুক্রবার দুপুরে সড়কের ভেদেরগঞ্জ উপজেলার মাদবরকান্দি এলাকায়
ফেরিঘাটের ইজারা নিয়ে বিএনপির দুই পক্ষের দ্বন্দ্বের জের ধরে চাঁদপুর–শরীয়তপুর সড়কে যানবাহন আটকে দেওয়া হয়েছে। শুক্রবার দুপুরে সড়কের ভেদেরগঞ্জ উপজেলার মাদবরকান্দি এলাকায়

শরীয়তপুর-চাঁদপুর নৌপথ

ফেরিঘাটের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যুবদল ও ছাত্রদল নেতার বিরোধ, অতিরিক্ত টাকা আদায়

শরীয়তপুর-চাঁদপুর নৌপথের নরসিংহপুর (আলুর বাজার) ফেরিঘাটের ইজারা নিয়ে যুবদল ও ছাত্রদলের দুই নেতার মধ্যে বিরোধ চলছে। ঘাটের আধিপত্য ধরে রাখতে দুই নেতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন বিএনপির তিন নেতা। ওই ঘাট ইজারা নিয়ে সড়ক ও নৌপথে যানবাহন থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায়ের অভিযোগ উঠেছে।

গত বৃহস্পতিবার রাতে থানা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও নরসিংহপুর ফেরিঘাটের ইজারাদার জিসান বালার সমর্থকেরা ফেরিঘাট দখলে নিতে সড়কের যানবাহন আটকে দেন। অন্যদিকে জেলা যুবদলের সাবেক সহসভাপতি ও ঘাটের সাবেক ইজারাদার মোমিন দিদারের সমর্থকেরা ফেরিঘাট দখল নেন। এ জন্য ১৮ ঘণ্টা শরীয়তপুর-চাঁদপুর সড়কে যানবাহন ও নৌপথের ফেরি চলাচল বন্ধ ছিল।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার সখিপুর থানার চরসেন্সাস ইউনিয়নের নরসিংহপুর এলাকায় ওই ফেরিঘাট অবস্থিত। যুবদল নেতা মোমিন দিদার ও ছাত্রদল নেতা জিসান বালা একই ইউনিয়নের বাসিন্দা। জিসান জেলা বিএনপির সভাপতি শফিকুর রহমান এবং মোমিন দিদার কৃষক দলের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি এস এম ফয়সাল ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের এপিএস মিয়া নুরুদ্দিন আহাম্মেদ অপুর অনুসারী। স্থানীয় রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে শফিকুর রহমানের সঙ্গে ওই দুই নেতার বিরোধ আছেন। জিসান ও মোমিন ওই তিন নেতার পক্ষে ফেরিঘাটে আধিপত্য বিস্তার করেন।

গত বছর আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ফেরিঘাটের ইজারা পান যুবদল নেতা মোমিন দিদার। তিনি ভ্যাটসহ ১ কোটি ৩১ লাখ টাকা পরিশোধ করে নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত ঘাটের ইজারা নেন। এরপর নতুন করে ইজারার দরপত্র আহ্বান করে বিআইডব্লিউটিএ। তখন ছাত্রদল নেতা জিসান বালা ৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা পরিশোধ করে চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে ঘাট ইজারা নেন।

বিআইডব্লিউটিএ ও বিআইডব্লিউটিসি সূত্র বলছে, ইজারার শর্ত অনুযায়ী ফেরিঘাটে যাতায়াত করা প্রতিটি যানবাহনের পার্কিং ইয়ার্ড ও ঘাট পার্কিং বাবদ ৭০ থেকে ১২৫ টাকা আদায় করা যাবে। আর লঞ্চঘাট ও ট্রলারঘাট ব্যবহার করা একজন যাত্রীর থেকে পাঁচ টাকা আদায় করা যাবে। প্রতিটি লঞ্চ থেকে ১৩০ টাকা ও ট্রলার থেকে ৩০ টাকা আদায় করা যাবে। তবে নির্ধারিত টাকার কয়েক গুণ বেশি টাকা আদায় করা হচ্ছে। কোনো যানবাহনের চালক প্রতিবাদ করলে তিনি মারধরের শিকার হন।

২০২২ সালে পদ্মা সেতু চালুর পর এ পথে যানবাহন ও যাত্রী চলাচল কমে যায়। এখন প্রতিদিন ১৯০ হতে ২০০টি যানবাহন নৌপথ ব্যবহার করে পারাপার হচ্ছে। আর প্রতিদিন লঞ্চ ও ট্রলারে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ মানুষ যাতায়াত করছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিআইডব্লিউটিসির এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ৩৬৫ দিনের ইজারার জন্য সাড়ে তিন কোটি টাকা জমা দেওয়া হয়েছে। প্রতিদিন গড়ে ৯৭ হাজার টাকা। কিন্তু ফেরির যানবাহন, লঞ্চ-ট্রলারের যাত্রী থেকে সরকারনির্ধারিত টোল আদায় করলে কোনো অবস্থায় প্রতিদিন ৩৫ হাজার টাকার বেশি আদায় সম্ভব নয়। স্বাভাবিকভাবে টোল আদায় করলে ইজারার টাকা তুলতে ইজারাদারের দুই থেকে তিন বছর সময় লাগবে। এটা জানার পরও অতিরিক্ত টাকা দিয়ে ইজারা নেওয়া হয়েছে। গত অর্থবছরের ইজারামূল্য অর্ধেকের কম ছিল। এর প্রভাব যাত্রী ও যানবাহনের চালকদের ওপর পড়ছে। তাঁদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হচ্ছে।

শরীয়তপুর-চাঁদপুর নৌপথে চলাচলকারী যাত্রী ও যানচালকদের অভিযোগ, ফেরি পারাপার হতে যানবাহন ভেদে ইজারাদারের লোকজনকে এক হাজার থেকে দুই হাজার টাকা দিতে হয়। লঞ্চ ও ট্রলারে পারাপার হওয়া যাত্রীদের দিতে হয় ১০ টাকা করে। ঘাট দিয়ে যেসব লঞ্চ চলছে, তাদের প্রতি ট্রিপের জন্য এক হাজার ও ট্রলারের প্রতি ট্রিপে ৩০০ টাকা দিতে হচ্ছে। আর ওই এলাকা (নদী) দিয়ে যাতায়াত করা প্রতিটি নৌযানকে ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা দিতে হচ্ছে। কোনো চালক বা যাত্রীরা এর প্রতিবাদ করলে তাঁদের মারধর করা হয়। এ জন্য ভয়ে কেউ কিছু বলেন না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ট্রাকচালক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফেরিঘাটে আসার পর ইজারাদারের লোকজন আমাদের কাছ থেকে পার্কিং বাবদ টাকা তোলেন। আমাদের দিতে হয় ১ হাজার ২০০ টাকা। কিন্তু রসিদে লেখা আছে, ১২৫ টাকা। এটাই ঘাটের নিয়ম। অনেক বছর ধরে এ নিয়মেই আমাদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হচ্ছে। প্রতিবাদ করলে মারধর করা হয়।’

মাদারীপুরের মাছ ব্যবসায়ী লিয়াকত হোসেন খামারের মাছ বিক্রির জন্য চাঁদপুর ও নোয়াখালীতে পাঠান। প্রতিদিন রাতে তাঁর ট্রাক ফেরি দিয়ে পারাপার হয়। তাঁকে ফেরিতে সিরিয়াল পেতে দুই হাজার টাকা দিতে হয়। লিয়াকত প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাছ কাঁচামাল। এই বিবেচনায় আগেই ফেরির সিরিয়াল পাওয়ার কথা। কিন্তু ইজারাদারের লোকজন ট্রাক নিয়ে সামনে যেতে দেয় না। প্রতি ট্রিপে পার্কিং বাবদ দুই হাজার টাকা দিতে হয়।’

নরসিংহপুর ফেরিঘাটের ইজারাদার জিসান বালা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি সাড়ে তিন কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ইজারা নিয়েছি। সাবেক ইজারাদার প্রভাব বিস্তার করে আমাকে ঘাটে যেতে বাধা দিয়েছিল। আমরা পার্কিং, যাত্রী ও নদীতে চলাচল করা নৌযান থেকে টোল আদায় করছি। বিআইডব্লিউটিএ যে হার নির্ধারণ করে দিয়েছে, সেই অনুযায়ীই টাকা নিচ্ছি। কোনো বেশি টাকা নেওয়া হচ্ছে না।’

আগের ইজাদার মোমিন দিদার বলেন, গত বছর তিনি ইজারা তুলতে গিয়ে লোকসানে পড়েছেন। এ জন্য উচ্চ আদালতে মামলা করে তিন মাসের ইজারা আদায়ের আদেশ পেয়েছেন। তিনি যখন ইজারার টাকা আদায় করেছেন, তখন কোনো বেশি টাকা নেওয়া হয়নি। একটি পক্ষ তাঁর বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা ছড়াচ্ছে।

ফেরিঘাটের ইজারা নিয়ে ছাত্রদল ও যুবদল নেতার বিরোধের বিষয়ে কথা বলতে কৃষক দলের কেন্দ্রীয় নেতা এস এম ফয়সাল ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের এপিএস মিয়া নুরুদ্দিনের মুঠোফোনে কল করলেও তাঁরা ধরেননি। জেলা বিএনপির সভাপতি শফিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘তারা যেহেতু বিএনপির রাজনীতি করেন, তাই দুজনই আমার লোক। আমি আলাদা করে কাউকে প্রশ্রয় দিই না। ঘাটের ইজারা নিয়ে যে সমস্যা হয়েছে, সেটা প্রশাসন ও বিআইডব্লিউটিএ ঠিক করবে। সেখানে আইনগত বিষয় আছে। কেউ গায়ের জোরে কিছু করতে পারবে না। কেউ যাতে দলকে ব্যবহার করে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করতে না পারে, তা আমি খেয়াল রাখব।’

বিআইডব্লিউটিসির নরসিংহপুর ফেরিঘাটের ব্যবস্থাপক ইকবাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ফেরিঘাটের ইজারা আদায় করা হয় পন্টুনের বাইরে। সেখানে কী ঘটে, তিনি জানেন না। মাঝেমধ্যে গাড়িচালকেরা অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার কথা বলেন। তাঁরা বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন।