চট্টগ্রামের আনোয়ারার পারকি সৈকতে এভাবে উপড়ে পড়ে আছে ঝাউগাছ। গত শুক্রবার বিকেলে
চট্টগ্রামের আনোয়ারার পারকি সৈকতে এভাবে উপড়ে পড়ে আছে ঝাউগাছ। গত শুক্রবার বিকেলে

আনোয়ারার পারকি

নামেই টিকে আছে সৈকতটি

সেই পারকি আর আগের মতো নেই। পর্যটকের ভিড় থাকলেও সৌন্দর্যের অনেকটাই মুছে গেছে। ঝাউগাছও কমেছে, বসার জায়গাও তেমন নেই, সন্ধ্যা নামতেই আশপাশে নামে গুটগুটে অন্ধকার। আবার লাল কাঁকড়াও আগের মতো দেখা যাচ্ছে না। ন্যূনতম অবকাঠামোগত সুবিধা না থাকায় দর্শনার্থীরাও ফিরে যাচ্ছেন হতাশ হয়ে।

একসময় নাম ছিল ‘ঝাউবাগান’। ঝাউগাছের ঘন ছায়ায় বসে দেখা যেত জাহাজ চলাচল, লাল কাঁকড়ার দৌড়ঝাঁপ আর সূর্যাস্তের মনোরম দৃশ্য। এ সৌন্দর্যের কারণেই চট্টগ্রামের আনোয়ারার পারকি সৈকতের খ্যাতি ছড়িয়েছিল দেশজুড়ে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম শহর থেকে কম সময়ে, কম খরচে ঘুরতে যাওয়ার সুযোগ থাকায় দ্রুত জনপ্রিয় হয় জায়গাটি।

সেই পারকি আর আগের মতো নেই। পর্যটকের ভিড় থাকলেও সৌন্দর্যের অনেকটাই মুছে গেছে। ঝাউগাছও কমেছে, বসার জায়গাও তেমন নেই, সন্ধ্যা নামতেই আশপাশে নামে গুটগুটে অন্ধকার। আবার লাল কাঁকড়াও আগের মতো দেখা যাচ্ছে না। ন্যূনতম অবকাঠামোগত সুবিধা না থাকায় দর্শনার্থীরাও ফিরে যাচ্ছেন হতাশ হয়ে। দুই বছর ধরেই এসব অব্যবস্থাপনার মধ্যে রয়েছে সৈকতটি।

সৈকতের অবস্থা দেখতে গত শুক্রবার বিকেলে সরেজমিনে যান প্রতিবেদক। প্রধান সড়ক থেকে সৈকতে প্রবেশ করতেই দেখা যায় সময় বিভিন্ন যানবাহন থেকে টোল নেওয়া হচ্ছে। এসব নিয়েও পর্যটকদের সঙ্গে টোল আদায়কারীদের বাগ্‌বিতণ্ডা হচ্ছে। অনেকেই টোল দেওয়ার ঝামেলা এড়াতে সৈকত না গিয়ে ফিরে যাচ্ছেন। টোল বক্স অতিক্রম করতেই চোখে পড়ে রাস্তার দুই পাশ দখল করে গড়ে তোলা দোকান ও ঝুপড়ি। একটু এগিয়ে সৈকতে নামতেই দেখা গেল জোয়ারের পানি একেবারে রাস্তা ছুঁই ছুঁই করছে। সামনেই পড়ে রয়েছে দুটি ঝাউগাছ।

সৈকতটিতে গত তিন বছরে তিন শতাধিক ঝাউগাছ উপড়ে পড়েছে। একটু সামনে আগাতেই দেখা যায় বিস্তীর্ণ সৈকতে নামতে শুরু করেছেন লোকজন। তবে আশপাশের বসার জায়গা না পাওয়ায় হতাশ হচ্ছেন অনেকে।

লোকজন জানালেন, শুধু এই দুই গাছ নয়, সৈকতটিতে গত তিন বছরে তিন শতাধিক ঝাউগাছ উপড়ে পড়েছে। একটু সামনে আগাতেই দেখা যায় বিস্তীর্ণ সৈকতে নামতে শুরু করেছেন লোকজন। তবে আশপাশের বসার জায়গা না পাওয়ায় হতাশ হচ্ছেন অনেকে।

সরেজমিনে দেখা যায়, পারকি সৈকতটি মূল পয়েন্ট থেকে আধা কিলোমিটার দক্ষিণ ও দুই কিলোমিটার উত্তরে কর্ণফুলী নদীর মোহনার কাছাকাছি পর্যন্ত বিস্তৃত। তবে পর্যটকেরা মূল পয়েন্টের এক থেকে দেড় কিলোমিটার জায়গাজুড়ে বিচরণ করেন। দেড় কিলোমিটার জায়গায় কোনো রেস্তোরাঁ কিংবা রিসোর্ট নেই। ফলে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সৈকতসংলগ্ন ঝুপড়ির দোকান থেকে খাবার খেতে হয় দর্শনার্থীদের।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ছুটির দিনে অন্তত পাঁচ হাজার দর্শনার্থী পারকি সৈকত ঘুরতে আসেন। কিন্তু এসবের বিপরীতে পর্যাপ্ত অবকাঠামো নেই। নামমাত্র দুটি রেস্তোরাঁ, ২০টির ঝুপড়ি দোকান, ১০টি অস্থায়ী দোকান রয়েছে। এর বাইরে চারটি স্পিড বোট, আটটি বিচ মোটরসাইকেল রয়েছে। দুটি পাবলিক শৌচাগার থাকলেও সুপেয় পানির ব্যবস্থা সেখানে নেই। আবার সৈকত এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় সন্ধ্যা নামতেই ভুতুড়ে পরিবেশ তৈরি হয়।

নগরীর বায়েজিদ এলাকা থেকে বেড়াতে আসা ইমরান হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘কম খরচে বেড়াতে পারায় আমরা এ সৈকতে এসেছি। তবে অব্যবস্থাপনার কারণে নানান হয়রানির শিকার হতে হয়েছে।’ লোহাগড়া উপজেলার আধুনগর থেকে বেড়াতে আসা ফরিদুল আলম বলেন, ‘সৈকতের নাম শুনে এখানে বেড়াতে এসেছি। কিন্তু এখানে বসার জায়গাও নেই। এ নিয়ে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।’

বন বিভাগ সূত্র জানায়, আনোয়ারা উপকূলকে রক্ষা জন্য পারকি সৈকতের বালিয়াড়িতে ১৯৯২-৯৩ অর্থবছরে ১২ হেক্টর জায়গায় আর্কিটেকচারাল পদ্ধতিতে ঝাউগাছ লাগানো হয়। এরপর ১৯৯৩-৯৪ অর্থবছরে ১৭ দশমিক ২ হেক্টর, ২০০৩-০৪ অর্থবছরে ৫ হেক্টর ও ২০০৪-০৫ অর্থবছরে ৫ হেক্টর জায়গায় ঝাউবাগান করা হয়। এই সবুজ বেষ্টনী পারকি সৈকতের সৌন্দর্য বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি থেকেও রক্ষা করত। তবে প্রতিবছরই দুর্যোগেই সৈকতের ঝাউগাছ কমেছে।

ছুটির দিন এলেই সৈকতটিতে বাড়ে পর্যটকের ভিড়। তবে পর্যাপ্ত অবকাঠামো ও ব্যবস্থাপনা না থাকায় হতাশ হয়ে ফিরে যান তাঁরা। গত শুক্রবার আনোয়ারার পারকি সৈকতে

অন্যদিকে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে পারকি সৈকতসংলগ্ন এলাকায় ১৩ দশমিক ৩৩ একর জায়গায় ৭৯ কোটি টাকার একটি উন্নয়ন প্রকল্প শুরু হয়। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে এখনো এ প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি। প্রকল্পটির কাজ পুরোপুরি শেষ হলে পারকি সৈকতের চিরচেনা চেহারা বদলে যেত।

পারকি সৈকতের দোকানি লেয়াকত আলী বলেন, পারকি সৈকতের মূল আকর্ষণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এটিই এখন আর নেই। লাল কাঁকড়া এখন তেমন দেখতে পাওয়া যায় না। আগে সারা বছর এটি দেখা যেত। তাই পর্যটকেরা হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন।

সৈকতের পাশের একটি হোটেলের কর্মচারী মো. রানা বলেন, সৈকতের উত্তর পাশে বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় সন্ধ্যার পরপরই পর্যটকেরা আর সৈকতে থাকছেন না।
জানতে চাইলে পারকি সৈকত পর্যটন কমপ্লেক্সর প্রকল্প পরিচালক মাজেদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, পুরো প্রকল্পের কাজ ৮০ শতাংশের বেশি শেষ। আগামী ডিসেম্বরের আগে পুরো প্রকল্পটি বুঝে পাব। তখন সেবার মান বৃদ্ধি পাওয়া। পর্যটকেরাও সন্তুষ্ট হবেন।