চমেক হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছেন কারাগার থেকে আসা অসুস্থ এক বন্দী। তাঁকে পাহারায় তিন কারারক্ষী ও এক পুলিশ সদস্য। সম্প্রতি তোলা
চমেক হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছেন কারাগার থেকে আসা অসুস্থ এক বন্দী। তাঁকে পাহারায় তিন কারারক্ষী ও  এক পুলিশ সদস্য। সম্প্রতি তোলা

‘ছেলের বেডের পাশে পুলিশ, খুব অস্বস্তি লাগে’

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঁচ বছর ধরে পড়ে আছে প্রিজন সেল। বন্দীদের চিকিৎসা হচ্ছে সাধারণ ওয়ার্ডে। একজন বন্দীর পেছনে দৈনিক ১০ জন কারারক্ষী ও পুলিশকে পাহারায় থাকতে হয়। অথচ হাসপাতালে প্রিজন সেল চালু হলে সব বন্দী, আসামিকে পাহারায় লাগত ছয় থেকে সাতজন।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন ছেলের বিছানার পাশে বসে ছিলেন হাজেরা বেগম। বয়স্ক এই নারীর চোখমুখে ক্লান্তি আর বিরক্তি। তাঁর ছেলের শয্যার পাশেই এক আসামির শয্যা। আর সেই শয্যা ঘিরে ছিলেন চারজন কারারক্ষী ও পুলিশ। হাজেরা বেগমকে এ কারণে সব সময় সতর্ক থাকতে হয়। ওয়ার্ড থেকে নানা কাজে বাইরে যাওয়া কিংবা ছেলের পাশে ঘুমানোও তাঁর জন্য বিব্রতকর বলে জানালেন। হাজেরা বলেন, ‘দিনরাত ছেলের সঙ্গে আছি। ছেলের বেডের পাশেই পুলিশ। খুব অস্বস্তি লাগে।’

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ৩০ শয্যার প্রিজন সেল থাকলেও পাঁচ বছর ধরে সেটি খালি পড়ে আছে। পৃথক সেল না থাকায় বিভিন্ন ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছেন কারাগার থেকে আসা অসুস্থ বন্দীরা। পাশাপাশি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার আসামিদেরও চিকিৎসা দেওয়া হয় সাধারণ রোগীদের সঙ্গে। তাঁদের সঙ্গে পাহারায় থাকেন কারারক্ষী ও পুলিশরা। এতে অস্বস্তিতে থাকেন হাজেরার মতো সাধারণ রোগীদের স্বজনেরা। সাধারণ ওয়ার্ডে বন্দীদের চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষেত্রে নিরাপত্তার ঝুঁকি আছে বলেও স্বীকার করেছেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এ ক্ষেত্রে বন্দীদের চিকিৎসাস্থলে বহিরাগতদের আনাগোনা বন্ধ করাও কঠিন হয়ে পড়ছে। চমেক হাসপাতালে আলাদা প্রিজন সেল চালুর জন্য কারা কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ চমেক কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।  

চমেক হাসপাতালে কারাগার ও থানা থেকে আসা ১০ জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন বর্তমানে। তাঁদের পাশের শয্যায় থাকা অন্তত ১৫ জন রোগীর স্বজন অভিযোগ করেছেন, তাঁরা অস্বস্তিতে থাকেন কারারক্ষী ও পুলিশের কারণে।

পুলিশের অভিযানে পালাতে গিয়ে আহত আসামিদেরও চিকিৎসার জন্য আনা হয় হাসপাতালে। প্রিজন সেল না থাকায় তাঁরাও চিকিৎসা নেন বিভিন্ন ওয়ার্ডে। সরেজমিন দেখা যায়, হাসপাতালের ক্যাজুয়ালটি ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছেন চান্দগাঁও থানা-পুলিশের হাতে আটক আসামি সাইফুল ইসলাম। তাঁর পাশে পাহারায় আছেন কনস্টেবল মো. সিয়াম ও মো. জোবায়ের। তাঁদের আশপাশে অন্য সব রোগী। চিকিৎসাধীন নুরনবীর স্ত্রী সালেহা খাতুন বলেন, ‘আমাদের পাশে দুজন পুলিশ পাহারায় থাকায় সারাক্ষণ বিব্রতবোধ করি।’

বন্দীদের পাহারায় পুলিশ ও কারারক্ষী মোতায়েন রাখার কারণে এই দুই বাহিনীর স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হচ্ছে। কারা সূত্র থেকে জানা গেছে, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, কক্সবাজার, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর কুমিল্লাসহ ১১টি কারাগারে গুরুতর অসুস্থ বন্দীদের উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়। হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে তাঁদের রাখা হয়। একজন বন্দীর পাহারায় দৈনিক ছয়জন কারারক্ষী ও চারজন পুলিশ লাগে। হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বাড়তি হওয়ায় মেঝেতেও অনেক রোগীকে থাকতে হয়। এর বাইরে একজন বন্দীর পাহারায় দৈনিক ১০ জন পুলিশ ও কারারক্ষী থাকেন। এ কারণে অস্বস্তিতে থাকার কথা জানিয়েছেন সাধারণ রোগীর স্বজনেরা।

চমেক হাসপাতালের নিচতলার একটি কক্ষে ২০১১ সালে বন্দীদের জন্য প্রিজন সেল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। তবে সেখানে পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা না থাকায় কিছুদিন পর এটি বন্ধ হয়ে যায়। পরে ২০১৯ সালের শেষের দিকে দ্বিতীয় তলায় পশ্চিম পাশে নতুনভাবে ৭৫ ফুট দীর্ঘ ও ২৬ ফুট প্রশস্ত একটি কক্ষ বরাদ্দ দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। নারী ও পুরুষ বন্দীদের জন্য এখানে ১৫টি করে ৩০টি শয্যা রয়েছে। কিন্তু এখনো ব্যবহারের উপযোগী করা হয়নি। সরেজমিন দেখা যায়, প্রিজন সেলটিতে অযত্নে পড়ে আছে নারী ও পুরুষ শয্যা। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন সরঞ্জাম।
বন্দীদের পাহারায় পুলিশ ও কারারক্ষী মোতায়েন রাখার কারণে এই দুই বাহিনীর স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হচ্ছে। কারা সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, কক্সবাজার, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর কুমিল্লাসহ ১১টি কারাগারে গুরুতর অসুস্থ বন্দীদের উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়। হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে তাঁদের রাখা হয়। একজন বন্দীর পাহারায় দৈনিক ছয়জন কারারক্ষী ও চারজন পুলিশ লাগে। হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বাড়তি হওয়ায় মেঝেতেও অনেক রোগীকে থাকতে হয়। এর বাইরে একজন বন্দীর পাহারায় দৈনিক ১০ জন পুলিশ ও কারারক্ষী থাকেন। এ কারণে অস্বস্তিতে থাকার কথা জানিয়েছেন সাধারণ রোগীর স্বজনেরা।

অন্য কারাগার থেকে চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রামে পাঠানো হলেও পাহারায় থাকেন চট্টগ্রাম কারাগারের কারারক্ষীরা। বন্দীর তুলনায় কারারক্ষীর সংখ্যা কম থাকলেও হাসপাতালে পাহারায় দৈনিক একজন বন্দীর পেছনে ছয়জন কারারক্ষীকে রাখতে হয়।
নগর পুলিশ কমিশনার হাসিব আজিজের সই করা এক চিঠি গত জুলাই মাসে পাঠানো হয় চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। এতে বলা হয়, চমেক হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম কারাগার ও পুলিশি হেফাজতে থাকা আসামিদের চিকিৎসার জন্য আনা হয়। হাসপাতালে প্রিজন সেল থাকা সত্ত্বেও বন্দী ও আসামিদের বিভিন্ন ওয়ার্ডে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এতে আসামির পলায়নের ঘটনাও ঘটেছে। গত ১৬ এপ্রিল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অস্ত্র মামলার আসামি রফিকুল ইসলাম হাতকড়াসহ পালিয়ে যান। পরে তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ ছাড়া প্রিজন সেলে আসামি না রাখা হলে বহিরাগতদের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয় না। নিরাপত্তার জন্য হাসপাতালে ১৫০ থেকে ২০০ পুলিশ মোতায়েন রাখতে হয়। বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন থাকায় নগরের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বাকি পুলিশ সদস্যদের হিমশিম খেতে হয়।

চালু না করায় খালি পড়ে আছে প্রিজন সেল। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দ্বিতীয় তলায়। সম্প্রতি তোলা

আসামিদের নিরাপত্তার ও জনবল সাশ্রয়ে গত ২৭ মে সিএমপির সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় আইসিইউ, সিসিইউতে ভর্তিযোগ্য গুরুতর অসুস্থ ছাড়া বাকিদের প্রিজন সেলে রেখে চিকিৎসার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু সেটি বাস্তবায়িত না হওয়ায় ২১ জুলাইয়ের সমন্বয় সভায় পুনরায় ১ আগস্ট থেকে প্রিজন সেল চালুর সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু এবারও সেটি হয়নি।

নগর পুলিশের উপকমিশনার (অপরাধ) রইছ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, প্রিজন সেল চালু হলে বাড়তি দেড় শ পুলিশ সদস্যকে দৈনিক দায়িত্ব পালন করতে হতো না। সেখানে ১০ থেকে ১২ জনেই কাজ হয়ে যেত। বারবার বলা সত্ত্বেও এটি চালু হচ্ছে না।
চট্টগ্রাম রেঞ্জের কারা উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজন) মো. ছগির মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, প্রিজন সেল চালু হলে বাড়তি কারারক্ষী পাহারায় থাকতে হবে না। নিরাপত্তাঝুঁকিও কমবে। বারবার তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এটি চালু করছে না।

জানতে চাইলে চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ তসলিম উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, কিছু লোকবলসংকট রয়েছে। শিগগিরই এটি চালু করা হচ্ছে।