
স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ‘মাছরাঙা’। এই বুঝি ছোঁ মেরে পানি থেকে তুলে আনবে কাঙ্ক্ষিত শিকার। গাছের মধ্যে ঠোকর দেওয়ার ভঙ্গিতে দাঁড়ানো ‘কাঠঠোকরা’। মাথা ঝুঁকিয়ে খাবার খাচ্ছে দুটি ‘চড়ুই’। গলা উঁচিয়ে দাঁড়ানো ‘ধলা বালিহাঁস’। আর ওদিকে গুটি গুটি পায়ে হাঁটার ভঙ্গিমায় ‘দেশি কানিবক’। হঠাৎ ‘ভুবনচিলের’ আগমনে মুহূর্তেই যেন স্থির হলো সবকিছু।
এমন বিভিন্ন প্রজাতির ১৬৬টি পাখি নিজের ভঙ্গিমায় বসে কিংবা দাঁড়িয়ে আছে। দেখে মনে হতে পারে, পাখিদের মেলা বসেছে। পাশে দাঁড়ানো কুকুর, শিয়াল ও বেজি দেখে একটুও ভয় পাচ্ছে না পাখিগুলো। কারণ, কারও মধ্যেই প্রাণ নেই!
এমন চার শতাধিক মৃত প্রাণীর দেখা মিলবে দিনাজপুর সরকারি কলেজে। তাদের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের একটি কক্ষে করা হয়েছে ট্যাক্সিডার্মি জাদুঘর। এর অর্থ হলো এখানে মৃত প্রাণীর চামড়া রাসায়নিকভাবে প্রক্রিয়াজাত করে একটি কৃত্রিম কাঠামোর ওপর জীবন্ত প্রাণীর মতো উপস্থাপন করা হয়। বলা চলে, এটি মৃত প্রাণীর জাদুঘর।
১৯৫৭ সালে ধর্ম প্রচারের কাজে দিনাজপুরে আসেন ইতালির নাগরিক গিওভ্যানি বারবে। তিনি দিনাজপুরে মিশনারি পরিচালিত সেন্ট যোসেফ স্কুলের পরিচালকের দায়িত্ব পান। তিনি ছিলেন ধর্মযাজক ও শৌখিন প্রকৃতিবিদ।
দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক বছর পর গিওভ্যানি বারবে দিনাজপুর শহরের সেন্ট ফিলিপস হাইস্কুলের বিশপ হাউসে ট্যাক্সিডার্মি জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠা করেন। সহকর্মী ও স্থানীয় সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ফিলিপাইন, পাকিস্তানের করাচি ও বাংলাদেশের পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুরের বীরগঞ্জ, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে জাদুঘরে সংরক্ষণ করেন। ১৯৭২ সালে তিনি ইতালিতে ফিরে যান। এরপর অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকে জাদুঘরটি।
ট্যাক্সিডার্মি জাদুঘর হলো যেখানে মৃত প্রাণীর চামড়া রাসায়নিকভাবে প্রক্রিয়াজাত করে একটি কৃত্রিম কাঠামোর ওপর জীবন্ত প্রাণীর মতো উপস্থাপন করা হয়। বলা চলে, এটি মৃত প্রাণীর জাদুঘর।
১৯৮৬ সালে সেন্ট ফিলিপস হাইস্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণিবিদ্যা বিভাগের। এত দুর্লভ ও মূল্যবান সম্পদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাওয়ার খবরটি পান দিনাজপুর সরকারি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তৎকালীন শিক্ষক ও অধ্যক্ষ রেজাউল হক। তিনিসহ অন্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা আপত্তি তোলেন। নিয়ে আসেন দিনাজপুর সরকারি কলেজে।
জাদুঘরের পশ্চিম দেয়াল ঘেঁষে আছে একটি আলমারি। উচ্চতা ২২ ফুট, দৈর্ঘ্য ৩০ ফুট। এখানে পরিচিত পাখির পাশাপাশি বিলুপ্ত তিলানাগ, বড় কুবো, নীল শির, গৃহবাসী বাতাসি, মেটে লটোড়া, তিলা মুনিয়া, আবাবিল, মোহনচূড়া, নিরলঠুঁটি ধনেশ, নীলকণ্ঠসহ বিভিন্ন প্রজাতির ১৬৬টি পাখি আছে।
এ ছাড়া আছে ছোট-বড় আরও ১৩টি আলমারি। কক্ষের মাঝবরাবর লম্বাকৃতির একটি টেবিল। আলমারি ও টেবিলে নানা আকৃতির পাঁচ শতাধিক কাচের বোতল। তাতে ফরমালিন দিয়ে রাখা বিভিন্ন প্রজাতির সাপ, ব্যাঙ, কাঁকড়া, সামুদ্রিক মাছ, অক্টোপাস, শামুক, ঝিনুক, গিরগিটি, জোঁক, কেঁচো, কাঠবিড়ালি, ইঁদুর, বাদুড়, স্পঞ্জ, হাইড্রা ও জেলিফিশ। আছে মানবভ্রূণসহ মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ (কিডনি, হাড়, ফুসফুস) ও বিভিন্ন ধরনের কৃমি। প্রতিটি প্রাণীর পাশে কাগজে নামসহ প্রয়োজনীয় তথ্যও লেখা আছে। এসব পশুপাখি দেখতে ও গবেষণাকাজে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত শিক্ষার্থীসহ অনেক মানুষের ভিড় লেগে থাকে।
সরেজমিন একদিন
সম্প্রতি জাদুঘরটি ঘুরে দেখা গেল, টার্ম পেপারের জন্য জনা দশেক শিক্ষার্থীর সঙ্গে নমুনা সংগ্রহ করছেন প্রাণিবিদ্যার শিক্ষক মিজানুর রহমান। জাদুঘরের অধিকাংশ নমুনা এখন বাস্তবে প্রায় বিলুপ্ত। অনেক নমুনার সঙ্গে লাগানো পরিচিতিমূলক কাগজের লেখা মুছে গেছে। পাখি ও প্রাণীর লোম-চামড়া বিবর্ণ হয়ে পড়েছে। তাই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ইন্টারনেট ঘেঁটে প্রতিটি নমুনার আসল রং ও বৈশিষ্ট্য নতুন করে শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে।
১৯৫৭ সালে ধর্ম প্রচারের কাজে দিনাজপুরে আসেন ইতালির নাগরিক গিওভ্যানি বারবে। তিনি ছিলেন শৌখিন প্রকৃতিবিদও। দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক বছর পর তিনি দিনাজপুর শহরের সেন্ট ফিলিপস হাইস্কুলের বিশপ হাউসে ট্যাক্সিডার্মি জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠা করেন।
এই জাদুঘরে থাকা পাখি ও প্রাণীর মমিগুলো দেশের সম্পদ এবং প্রাণিবিদ্যা শিক্ষার বড় উপকরণ, বলছিলেন প্রাণিবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান জেসমীন আরা বেগম (সদ্য অবসরপ্রাপ্ত)। তিনি বলেন, বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অধ্যাপক জলিল আহমেদ উদ্যোগ নিয়ে জাদুঘরটি সংস্কার করেছিলেন। সম্প্রতি অবকাঠামোগত কিছু উন্নয়ন হওয়ায় নমুনাগুলো কিছুটা গুছিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে। শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক ক্লাসের উপযোগী করা হয়েছে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণ না হওয়ায় অনেক মমি ক্ষতিগ্রস্ত। সঠিক সংরক্ষণ ব্যয়সাপেক্ষ; বিভাগের পক্ষে তা করা কঠিন—তাই সরকারি উদ্যোগ ও নজরদারি অপরিহার্য।