
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইনের খসড়ায় সরকারি প্রতিষ্ঠান ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনভাবে তদন্ত ও ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা কমিশনকে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। একই সঙ্গে গুম ও খুন প্রতিরোধে আলাদা আইন প্রণয়নের বিষয়টি খসড়ায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
আজ শনিবার সকালে কক্সবাজারের ইনানী সৈকতের হোটেল বেওয়াচে অনুষ্ঠিত এক পরামর্শ কর্মশালায় এই খসড়া আইন উপস্থাপন করা হয়। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন, ২০০৯-এর সংশোধনবিষয়ক পরামর্শ কর্মশালায় প্রধান অতিথি ছিলেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। খসড়া আইন সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘দেশের মানুষের জন্য শক্তিশালী একটি জাতীয় মানবাধিকার কমিশন দরকার। আমরা যদি শক্তিশালী মানবাধিকার কমিশন করতে না পারি, বিপরীতে কী হয়, সেটা আমরা আওয়ামী লীগের ১৫ বছরে দেখতে পেয়েছি। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মানবাধিকার রক্ষা তো দূরের কথা, বরং গুম-খুনসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বেশি ঘটেছে। আইনেও ছিল সীমাবদ্ধতা। এই সরকার মানবাধিকার রক্ষায় একটি মাইলফলক স্থাপন করে দিয়ে যেতে চায়।’
কর্মশালায় জুলাই অভ্যুত্থানের প্রসঙ্গ তুলে ধরে উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানে ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আর আত্মত্যাগের পর ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে। সেই নির্বাচনে ক্ষমতায় এসে একটা রাজনৈতিক দল এই মানবাধিকার কমিশনের আইন বাতিল করবে, এতটা নিরাশাবাদী আমরা হব না। তবে এটাও ঠিক, রাজনৈতিক দলগুলো আইন করে নিজেদের সুযোগ-সুবিধার জন্য, ক্ষমতা হাতে রাখার জন্য। আমাদের চিন্তা হচ্ছে ক্ষমতা সম্পূর্ণ সরকারের হাতে না থেকে ইনডিপেনডেন্ট বডির কাছে থাকুক। আমরা মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাব।’
আইন মন্ত্রণালয়ের সংসদবিষয়ক বিভাগ, নিউজিল্যান্ডের আন্তর্জাতিক সংস্থা লেজিসলেটিভ ও ইউএনডিপির যৌথ আয়োজনে এই কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। সকাল ১০টায় শুরু হওয়া এই কর্মশালা বেলা দেড়টায় শেষ হয়।
আয়োজকেরা জানান, মানবাধিকার কমিশন আইন, ২০০৯ রহিত করে নতুনভাবে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ ২০২৫ প্রণয়নের খসড়া তৈরি হয়েছে। এই খসড়া নিয়েই কর্মশালা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কর্মশালায় পাওয়া সুপারিশ সংযোজন করে পুরো খসড়া নীতিমালা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে বলে জানান তাঁরা।
কর্মশালায় বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, গুম তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী, সুইজারল্যান্ডের বাংলাদেশ দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত রিটু সিনফ্রেড রেনগলি, সুইডেনের বাংলাদেশ নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত নিকোলাস ইউকস, ইউএনডিপির বাংলাদেশের আবাসিক প্রতিনিধি স্টেফান লিলার। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন-২০২৫–এর খসড়া আইন উপস্থাপন করেন আইন মন্ত্রণালয়ের স্পেশাল কনসালট্যান্ট ব্যারিস্টার তানিম হোসাইন।
তানিম হোসাইন বলেন, সরকার এখন যে জাতীয় মানবাধিকার আইন করতে যাচ্ছে, তা ২০০৯ সালের আইনে প্রতিস্থাপন করা হবে। ২০০৯ সালের আইনে কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল, যেমন সরকারি কোনো কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সরাসরি কমিশন ব্যবস্থা নিতে পারত না। খসড়ায় তা বাদ দিতে বলা হয়েছে। কমিশন সরাসরি ঘটনার তদন্ত, অনুসন্ধান করতে পারবে। আগে কমিশনের ওপর সরকারের নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপ ছিল। এখন তা বন্ধ করে সাত সদস্যবিশিষ্ট কমিটি রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। কমিশন সদস্যদের সুযোগ-সুবিধা সরকারি কর্মকর্তাদের সমতুল্য রাখা হয়েছে। মানবাধিকার কমিশন ঢাকাকেন্দ্রিক—নতুন খসড়ায় বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কমিশন বিস্তৃতির প্রস্তাব করা হয়েছে। কমিশনের বাজেট আগে মন্ত্রণালয়ে আসে। সেখানে থেকে যায়, বাজেট কাটছাঁট হয়। চাহিদামতো বাজেট পাওয়া যায় না। সে ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের মতো সরাসরি সংযুক্ত তহবিল থেকে বাজেট দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
নতুন আইনটি মানুষের জন্য উপকারী হবে উল্লেখ করে শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেন, আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের যে দুঃশাসন, গুম ও খুন হয়েছে, তা যেন চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়। তার জন্য জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ করতে যাচ্ছে সরকার। জুলাই অভ্যুত্থানের সময় কমিশনের ভূমিকা ছিল ন্যক্কারজনক। এখন দেশে গুম তদন্ত কমিশন আছে, হয়তো একটা সময় থাকবে না। কিন্তু গুম তো বন্ধ থাকবে না। সে জন্য শক্তিশালী ও স্বাধীন জাতীয় মানবাধিকার কমিশন দরকার।
আইনের খসড়া নিয়ে মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন কক্সবাজার চেম্বারের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী, আইনজীবী তাসনিয়া সুলতানা, কবি ও সমাজকর্মী শামীম আকতার, কক্সবাজার জেলা মহিলা ও শিশু অধিকার রক্ষা কমিটির সভাপতি মনোয়ারা পারভিন, কক্সবাজার প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মমতাজ উদ্দিন বাহারী, মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র ‘নোঙর’–এর নির্বাহী পরিচালক দিদারুল আলম রাশেদ, মানব পাচার রোধের বেসরকারি সংস্থা ‘হেল্প’-এর নির্বাহী পরিচালক আবু কাশেম, কক্সবাজার সিটি কলেজের প্রভাষক জাহাঙ্গীর আলম, ইপসার কর্মকর্তা শহীদুল আলম, বান্দরবানের সমাজকর্মী লেমন খুমি, আইনের শিক্ষার্থী সাবিনা রহমান প্রমুখ।