নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি

‘মানুষ দাম হুইনাই দৌড় দেয়, আমাগোর হইসে যত জ্বালা’

কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে আধা লিটার পানির দাম ৫ টাকা বেড়েছে বলে জানালেন চা–দোকানি মামুন
ছবি: প্রথম আলো

গাজীপুর শহরের মাইক্রোস্ট্যান্ড মোড় থেকে মিতালীপাড়া গলি ধরে কিছুটা সামনে এগিয়ে গেলেই ছোট্ট চায়ের দোকান। নাম ‘মিতালী স্টোর’। আধাপাকা দোকানে তখন সান্ধ্য আড্ডা জমে উঠেছে। এর মধ্যেই মাঝবয়সী এক ব্যক্তি দোকানে এসে আধা লিটারের এক বোতল পানি চাইলেন। দোকানি মামুন ফ্রিজ থেকে পানির বোতল বের করে দিলেন। পানি কিনতে আসা ওই ব্যক্তি কোনো কথা না বলে দোকানির দিকে ১৫ টাকা বাড়িয়ে দিলেন। দোকানি টাকা না নিয়ে জানিয়ে দিলেন, আধা লিটার পানির দাম এখন ২০ টাকা। ৫ টাকা বেড়ে গেছে। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে দর–কষাকষি চলল। একপর্যায়ে হতাশ হয়ে পানি না কিনেই চলে যান ওই ব্যক্তি।

পানির বোতলটি আবার ফ্রিজে রাখতে গিয়ে দোকানে উপস্থিত ক্রেতাদের উদ্দেশে মামুন বললেন, ‘মানুষ যে পানি খাইয়্যা বাঁচব, তারও উপায় নাই। এই একটু পানির (পানির বোতল) দাম ২০ ট্যাকা। এক মাস আগেও দাম আছিল ১৫ ট্যাকা। সারা দিনে আগে পানি বেচতাম ১৫ থেইক্যা ২০ডা (বোতল)। এহন তিনডাও বেচা অয় না। মানুষ দাম হুইনাই দৌড় দেয়। আমাগোর হইসে যত জ্বালা।’

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পর ব্যবসার পরিস্থিতি নিয়ে মামুন হোসেনের কাছে আরও কিছু জানতে চাওয়া হলো। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে প্রশ্ন করতেই মামুন যেন তাঁর সব ক্ষোভ নিংড়ে দিলেন। মামুন বললেন ‘এই যে দেশের এই অবস্থা, জিনিসপত্রের দাম এত বেশি, সাধারণ মাইনষ্যের এত কষ্ট, আপনারা (সাংবাদিক) কী করেন? আপনের চোক্ষের সামনেই একটা লোক ৫ ট্যাকা দাম বাড়ার কারণে পানি না কিননাই চইল্যা গেল। এসব নিয়া ভালো কইর‍্যা লেখেন। আমরা আর পারতাছি না।’

এবার মামুন তাঁর চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। প্রতিটি পণ্য ধরে ধরে মূল্যবৃদ্ধির নমুনা দেখালেন। তাঁর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গেল দুই সপ্তাহে যেকোনো ব্র্যান্ডের আধা লিটার পানির দাম ছিল ১৫ টাকা থেকে বেড়ে ২০ টাকা হয়েছে। দুই মাস আগেও এক কৌটা কনডেন্সড মিল্ক কিনতেন ৬৫ থেকে ৭০ টাকায়। এখন সেটা বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকায়। কোমল পানীয়ের বিভিন্ন আকৃতির বোতলে গড়ে ৫ টাকা করে বেড়েছে। পাশাপাশি সাবান, টুথপেস্ট, চকলেটসহ সব পণ্যের দাম আকার ভেদে ৫ টাকা থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে।

মামুনের দাবি, নিত্যপ্রয়োজনীয় এসব পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া তাঁর বেচাকেনা অর্ধেকে নেমে এসেছে। অনেক ক্রেতা দাম শুনেই রেগে যান। আবার অনেকে অকারণে দর–কষাকষি করেন। ক্লাস এইট পর্যন্ত বড় মেয়ে।

মামুন হোসেনের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের নান্দাইল এলাকায়। তবে তিনি গাজীপুরের পূর্ব চান্দনা এলাকার একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। স্ত্রী ও তিন সন্তানসহ তাঁর পরিবারে মোট সদস্য পাঁচজন। দোকানের আয় দিয়েই সন্তানের পড়াশোনা আর সংসার খরচ চলে। কিন্তু বর্তমান জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ার পর ব্যবসায় ভাটা পড়েছে মামুনের। এতে দোকান ভাড়া, বাড়িভাড়া, সংসারের খরচের হিসাব মেলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাঁকে। এ অবস্থায় মাস দুয়েক আগে বড় ছেলের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে। পঞ্চম শ্রেণি পাস করেছে তাঁর বড় ছেলে। এ বছরের শুরু থেকে কাজে পাঠিয়েছেন। এর আগে করোনার সময় বড় মেয়েরও পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়েছেন। এখন শুধু ছোট ছেলে স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে।

মামুন বলেন, ‘এহন আর শুধু দোকানের আয় দিয়া চলার সুযোগ নাই। কাস্টমাররা ডরে দোকানে আসতে চায় না। এহন একটা সদাই কিনতে গেলে ১০ বার চিন্তা করে। খালি দোকানের আয় দিয়া চলতে পারতাছিলাম না। হেললাইগ্যা বাধ্য হইয়্যাই পোলামাইয়্যাগোর লেখাপড়া বন্ধ কইর‌্যা কাজে পাঠাইছি। একভাবে না একভাবে তো বাঁচন লাগব।’