
‘ছেলের আয়ে আমাদের সংসার চলত। মাঝেমধ্যে পারলে আমি কিছু করতাম। ছেলে না থাকায় এখন পুরো পরিবার অন্ধকারে পড়েছে।’ কথাগুলো বলছিলেন আজাদ মোল্লা। তাঁর বাড়ি রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দেবগ্রাম ইউনিয়নের পূর্ব তেনাপচা ঝুটুমিস্ত্রি পাড়া গ্রামে। উপজেলার নুরাল পাগলার দরবারে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনায় তাঁর ছেলে রাসেল মোল্লা (২৮) নিহত হয়েছেন।
ওই ঘটনায় পুলিশের ওপর হামলা ও গাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগে করা মামলায় ১১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর আগে শুক্রবার দিবাগত রাতে গোয়ালন্দ ঘাট থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সেলিম মোল্লা বাদী হয়ে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার অজ্ঞাত ব্যক্তিকে আসামি করে একটি মামলা করেন। নুরুল হক ওরফে নুরাল পাগলার বাড়ি ও দরবারে হামলা, ভাঙচুর এবং অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পরিবার থেকে এখন পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। তবে পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, তাঁরা মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
আজ সোমবার সকালে পূর্ব তেনাপচা ঝুটুমিস্ত্রি পাড়া গ্রামে দেখা যায়, নিহত রাসেল মোল্লার বাড়ির উঠানে শামিয়ানা টানানো। তাঁর বাবা আজাদ মোল্লা চেয়ারে বসে আছেন; কোলে দেড় বছর বয়সী নাতি (নিহত রাসেলের ছেলে) রাইয়ান। তাঁর পাশে আছেন সহিদ মোল্লা। তিনি নুরাল পাগলার দরবারের খাদেম। রাসেল মোল্লার কুলখানি আজ। একপাশে চলছে রান্নার আয়োজন। বাড়িতে লোকজনের ভিড়।
গণমাধ্যমকর্মীদের দেখে কেঁদে ওঠেন আজাদ মোল্লা। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে রাসেল সহজ–সরল প্রকৃতির। কী অপরাধ ছিল। এলাকার কেউ কখনো বলতে পারবে না রাসেল কোনোদিন কারও সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছে। আমার নিরপরাধ ছেলেকে নির্মমভাবে দুই দফা পিটিয়ে হত্যা করেছে। আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই।’
আজাদ মোল্লা আরও বলেন, ‘আমার মা-বাবা নুরাল পাগলার দরবারের ভক্ত ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে আমরাও দরবারের ভক্ত। রাসেল ছোটবেলা থেকে দরবারে আসা–যাওয়া করত। সে স্থানীয় একটি কোম্পানির গাড়ি চালাত। ঘটনার দিন (৫ সেপ্টেম্বর) জরুরি কাজে আমি ঢাকায় ছিলাম। বেলা তিনটার দিকে বাড়ি থেকে ফোন করে জানায় গোয়ালন্দ পাক দরবারে (নুরাল পাগলার দরবার) হামলা হয়েছে। রাসেল তখন দরবারে ছিল। বাড়ি ফেরার পথে সন্ধ্যায় জানতে পারি রাসেল মারা গেছে।’
গত শুক্রবার জুমার নামাজের পর বেলা তিনটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত দফায় দফায় নুরাল পাগলার দরবার ও বাড়িতে হামলা চালানো হয়। হামলাকারীরা শরিয়তপরিপন্থীভাবে দাফনের অভিযোগ তুলে নুরাল পাগলার লাশ কবর থেকে তুলে পুড়িয়ে দেন। উপজেলা ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটির পূর্বঘোষিত বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে সেখানে হামলা করা হয়। এতে ১০ থেকে ১২ জন পুলিশ সদসসহ অন্তত অর্ধশত ব্যক্তি আহত হন।
রাসেলের বড় চাচা দরবারের অন্যতম খাদেম সহিদ মোল্লা বলেন, ‘আমরা দরবারে জুমার নামাজ আদায় করে সবাই খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ওই সময় মিছিলের আওয়াজ শুনতে পাই। এ সময় দরবারে থাকা সহিদ ও আলামিন জানায় কোনো সমস্যা নাই। হঠাৎ দরবারের গেটে লাঠির আঘাত পড়তে থাকে। অনেকে বাইরে থেকে ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকে। এ সময় অনেকের হাতে দেশি অস্ত্র ছিল। তাঁরা ভেতরে ঢুকে সবাইকে মারধর শুরু করে। রাসেলও আমাদের সঙ্গে ছিল। প্রাণ বাঁচাতে যে যার মতো ছুটতে থাকি। কে কোথায় গেছে বলতে পারব না। আমার শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত লাগে; হাত ভেঙে যায়। সন্ধ্যায় জানতে পারি রাসেল মারা গেছেন।’
নিহত রাসেলের স্ত্রীর নাম হাসি আক্তার। তাঁদের চার বছর বয়সী মেয়ে ও দেড় বছর বয়সী একটি ছেলে আছে। হাসি আক্তার বলেন, ‘শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে আমি ফোন করে তাঁকে (রাসেল) বাড়ি আসতে বলি। সে বলে, “দরবারে আছি। জুমার নামাজের পর তবারক খেয়ে বাড়ি ফিরব।” বেলা তিনটার দিকে ফোন করে আবার জানায়, “দরবারের পরিস্থিতি ভালো না, হামলা হয়েছে। কখন জানি কী হয়, দোয়া কইরো।”’
হাসি আক্তার আরও বলেন, ‘স্থানীয় কয়েকজন রাসেলকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। জরুরি বিভাগ থেকে কয়েকজন রাসলেকে টেনে বাইরে বের করে আবার মারধর করতে থাকে, মাথায় কোপ দেয়। পরে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে সে মারা যায়। আমার স্বামীর কী দোষ ছিল? আমার ছোট ছোট দুইটা বাচ্চার এখন কী হবে? আমার স্বামী হত্যার বিচার চাই।’
গোয়ালন্দ ঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ রাকিবুল ইসলাম বলেন, ‘নিহত রাসেলের পরিবার থেকে এখন পর্যন্ত কোনো অভিযোগ দেয়নি। তবে তাঁদের আজ সোমবার বিকেলে আসতে বলেছি। পরিবার থেকে অভিযোগ পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর পাশাপাশি আমাদের মতো করে তদন্ত কাজ অব্যাহত রেখেছি।’