
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের আগেই মুক্ত হয়েছিল কিছু অঞ্চল। কেমন ছিল সেসব অঞ্চলের পরিবেশ, মানুষের আবেগ-অনুভূতি। সেই সময়ের চিত্র।
১৯৭১ সালের ২৯ নভেম্বরের কথা। ভোর থেকে পঞ্চগড় চিনিকলের দিকে এগোতে থাকেন মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর সদস্যরা। সঙ্গে ১২টি ট্যাংক। চিনিকল এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের শক্ত ঘাঁটি ঘিরে শুরু হয় দুই পক্ষের তুমুল লড়াই। পিছু হটে পাকিস্তানের সেনারা। মুক্ত হয় পঞ্চগড়।
বিজয়ের আনন্দে সবাই যখন উল্লসিত, তখন ঘটে এক বিষাদের ঘটনা। চিনিকল এলাকার গ্যারেজের সামনে পাকিস্তানের পতাকা উড়তে দেখে এগিয়ে যান তরুণ যোদ্ধা হারুন অর রশীদ। স্টেনগান কাঁধে নিয়ে দৌড়ে যান পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা ওড়াতে। সে সময় পাশের একটি বাংকারে আহত অবস্থায় পড়ে থাকা পাকিস্তানি সেনা গুলি করতে থাকেন। ঝাঁঝরা হয়ে যায় হারুনের বুক। বিজয়ের মুহূর্তে এমন ঘটনায় মর্মাহত হয়ে পড়েন তাঁর সহযোদ্ধারা। তাঁর বাড়ি পঞ্চগড় সদর উপজেলার হাঁড়িভাসা ইউনিয়নের উত্তর প্রধানপাড়া এলাকায়।
পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ নাজমুল হকের লেখা ‘পঞ্চগড় জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় পঞ্চগড়ের মধুপাড়া কোম্পানি কমান্ডার মাহবুব আলমের লেখা ‘গেরিলা থেকে সম্মুখ যুদ্ধে’ বইয়ে আছে সেই দিনের কথা।
মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে ও ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এ দেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেও ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত পঞ্চগড় মুক্ত ছিল। পাকিস্তানি বাহিনী সড়কপথে পঞ্চগড়ের দিকে এগোতে থাকে। ১৭ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৯টার দিকে তারা পঞ্চগড় দখল করে নেয়।
যুদ্ধে টিকতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা পিছিয়ে যান। আশ্রয় নেন মাগুরমারীতে। তাঁরা অমরখানা এলাকার চাওয়াই নদের সেতু ডিনামাইট দিয়ে ভেঙে দেন। ফলে পাকিস্তানি বাহিনী পঞ্চগড়ের সর্ব–উত্তরের এলাকা তেঁতুলিয়ায় ঢুকতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়কাল তেঁতুলিয়া মুক্তাঞ্চল ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল তেঁতুলিয়ার ঐতিহাসিক ডাকবাংলোতে বসে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পঞ্চগড় ছিল ৬ (ক) সেক্টরের আওতাধীন। এ অঞ্চলে মোট ৭টি কোম্পানির অধীন ৪০টি মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। জুলাই মাস থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণ বাড়তে থাকে। নভেম্বর মাসের শুরু থেকে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে মিত্রবাহিনী যৌথভাবে পাকিস্তানি বাহিনীর একের পর এক ক্যাম্পে আক্রমণ চালিয়ে সফল হতে থাকে।
সেই সব দিনের কথা স্মরণ করে বীর মুক্তিযোদ্ধা নূরুল ইসলাম বলেন, কয়েক মাসের যুদ্ধের পর মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণে নভেম্বর মাসের শেষ দিকে অমরখানা, জগদলহাট, শিংপাড়া, তালমা, পঞ্চগড় সিও অফিস আটোয়ারী ও মির্জাপুর থেকে পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটে। অবশেষে ২৯ নভেম্বর পঞ্চগড় চিনিকল এলাকা শত্রুমুক্ত হয়। ওই দিন তাঁরা পঞ্চগড় মুক্ত হওয়ায় বিজয় উল্লাস করেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে একজন সহযোদ্ধার মৃত্যু তাঁদের আনন্দকে বিষাদের ছায়ায় ঢেকে দেয়।
সহযোদ্ধাকে স্মরণ করে এত বছর পর পঞ্চগড়ের বীর মুক্তিযোদ্ধা সায়খুল ইসলাম বলেন, ‘পুরো যুদ্ধের সময় আমাদের অনেক সহযোদ্ধাই মারা গেছেন। কিন্তু ২৯ নভেম্বর বিজয়ের মুহূর্তে হারুন অর রশীদের মৃত্যুটা ছিল খুবই দুঃখজনক।’