হাসপাতালগুলোয় তিন থেকে পাঁচ বছর ধরে এক্স–রে যন্ত্র বিকল
সরকারি হাসপাতালে এক্স–রে করতে খরচ হয় ১৫০-২০০ টাকা। বেসরকারি হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকে লাগে ৫৫০-৮৫০ টাকা।
রংপুরের ছয়টি সরকারি হাসপাতালের ডিজিটাল এক্স-রে যন্ত্র কয়েক বছর ধরে বিকল হয়ে পড়ে আছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ রোগীরা। তাঁদের অন্যত্র গিয়ে এই সেবা নিতে হচ্ছে। এতে খরচ হচ্ছে বেশি এবং সময়ের অপচয় হচ্ছে।
রংপুর সিভিল সার্জনের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, মিঠাপুকুর, পীরগঞ্জ, পীরগাছা, কাউনিয়া ও গঙ্গাচড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং কাউনিয়ার হারাগাছ ৩১ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের ডিজিটাল এক্স-রে যন্ত্র দীর্ঘদিন ধরে বিকল হয়ে পড়ে আছে।
হাসপাতালসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই হাসপাতালগুলোয় তিন থেকে পাঁচ বছর ধরে এক্স–রে যন্ত্র বিকল থাকায় সাধারণ মানুষ হাতের নাগালে এমন সেবা পাচ্ছেন না। প্রয়োজনীয় এক্স-রে করাতে রোগীদের যেতে হচ্ছে রংপুর নগরে। এতে ভোগান্তি ও ব্যয় বাড়ছে। অপচয় হচ্ছে সময়ের।
রোগীদের অন্যত্র গিয়ে এই সেবা নিতে হচ্ছে। এতে খরচ হচ্ছে বেশি এবং সময়ের অপচয় হচ্ছে।
পীরগঞ্জের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা সাদিকাতুল তাহিরিন বলেন, ‘২০১৮ সালে কোটি টাকা মূল্যের ডিজিটাল এক্স-রে যন্ত্রটি হাসপাতালে বসানো হয়। মাত্র ১৪টি এক্স–রে করানোর পর থেকেই তা বিকল হয়ে পড়ে। অনেক চেষ্টায়ও তা আর চালু করা যায়নি। পরে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অনেক চিঠি চালাচালি করেছি, কাজ হয়নি। গত ১৯ ডিসেম্বর আমি ঢাকায় গিয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে যোগাযোগ করেও এক্স–রে সমস্যার সমাধান করাতে পারিনি।’
কাউনিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালের ডিজিটাল এক্স–রে যন্ত্র সাড়ে তিন বছর ধরে নষ্ট। টেকনোলজিস্টও নেই দুই বছর ধরে। প্রতিদিন হাসপাতালে গড়ে ২৫ জন রোগী পাওয়া যায়, যাঁদের এক্স–রে করার প্রয়োজন হয়। কিন্তু এখান থেকে এক্স–রে সুবিধা না পেয়ে ভুক্তভোগীদের ৩৩ কিলোমিটার দূরে রংপুর নগরের বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যেতে হয়। সেখানে হাসপাতালের চেয়ে চার গুণ বেশি টাকা লাগে। দীর্ঘদিন ধরে এই পরিস্থিতি চললেও সমস্যার সমাধান হয়নি।
কাউনিয়ার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মীর হোসেন বলেন, ‘আমার এখানে যোগদান করার প্রায় দুই বছর হলো। এর আগে থেকেই হাসপাতালের ডিজিটাল এক্স–রে যন্ত্রটি নষ্ট হয়ে পড়ে আছে।’
সম্প্রতি গঙ্গাচড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার লক্ষ্মীটারী এলাকার সবুর উদ্দিন (৪২) হাঁটুতে ব্যথা পেয়ে চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে এসেছেন। চিকিৎসক তাঁকে পরামর্শ দিয়েছেন এক্স-রে করানোর। সেখানকার এক্স–রে যন্ত্র বিকল শুনে সবুর উদ্দিন আক্ষেপ করে বলেন, ‘মুই এই হাঁটুয়ার বিষ (ব্যথা) ধরি এ্যালা রংপুরোত যাও কেমন করি? টাকা নাই, পাইশা নাই, এমনিতে সংসার চলা মুশকিল হইছে। হাসপাতালোত এক্স–রে হইলে কষ্ট, টাকা দুইটা থাকি বাঁচি গেইনো হয়।’
ওই হাসপাতালের ভেতরে সবুর উদ্দিনের সঙ্গে কথা বলার সময় এগিয়ে আসেন বড়বিল গ্রামের জমির উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘হাসপাতালের এই এক্স–রে মিশিন বহুদিন থাকি নষ্ট। রংপুর শহরোত জায়া হামাক এক্স–রে কইরবার নাগে। তাতে গাড়িভাড়া ও এক্স–রে খরচ মিলিয়া হাজার টাকা পড়ে। এ্যাটেকোনা (হাসপাতালে) করলে ২০০ টাকাতে হইত।’
বদরগঞ্জের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের টেকনোলজিস্ট রেজাউল ইসলাম বলেন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডিজিটাল এক্স–রে করাতে আকারভেদে ১৫০-২০০ টাকা ফি লাগে। একই এক্স–রে কোনো বেসরকারি হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকে করালে ৫৫০-৮৫০ টাকা ফি নেওয়া হয়।
পীরগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে কথা হয় সদর ইউনিয়নের তালুক ইসাদ গ্রামের মুনছুর আলীর (৫৬) সঙ্গে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘পাঁচ বছর থাকি শোনোং হাসপাতালের এসপেরে (এক্সরে) মেশিনটা নষ্ট। কোটি টাকা দিয়া সরকার মেশিন কিনে দিছে হামার গরিবের চিকিৎসা কইরবার। কিন্তু বছরের পর বছর তাক পড়ি আছে। আর হামাক বহুত পাইসা খরচ করি রংপুর শহরোত পরীক্ষা করির নাগে। তা হইলে হাসপাতালোত মেশিন থাকিয়া হামার লাভ কি হইল?’
এ বিষয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা কানিজ সাবিহা বলেন, ‘পীরগাছায় যোগদানের আমার এক বছর হচ্ছে। কাগজপত্র ঘেঁটে দেখেছি, ডিজিটাল এক্স–রে মেশিনটি মেরামত করার জন্য ২০১৮ সালে টেকনিশিয়ান আনা হয়েছিল। যেসব জিনিস নষ্ট, তার তালিকাও পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। যোগদানের পর যন্ত্রটি চালুর উদ্যোগ নিই। একজন প্রকৌশলী জানান, এর গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ নষ্ট, যা প্রচুর ব্যয়বহুল। আর মেরামত করলেও যন্ত্রটি তিন-চার মাসের মধ্যে পুনরায় বিকল হতে পারে। পরে বাধ্য হয়ে গত বছর নতুন ডিজিটাল এক্স–রে যন্ত্রের জন্য চাহিদাপত্র পাঠিয়েছি।’
রংপুরের সিভিল সার্জন শামীম আহম্মেদ বলেন, ‘হাসপাতালগুলোয় নষ্ট হয়ে পড়ে থাকা ডিজিটাল এক্স–রে যন্ত্রের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। আশা করছি, দ্রত সমস্যার সমাধান হবে।’