মনোয়ারা বেগম শহরের ময়লা কুড়ান। এটিকে তিনি ছোট কাজ মনে করেন না। তাঁর কোনো অভাব নেই। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজশাহী নগরের সাগরপাড়ার একটি ডাস্টবিনের সামনে
মনোয়ারা বেগম শহরের ময়লা কুড়ান। এটিকে তিনি ছোট কাজ মনে করেন না। তাঁর কোনো অভাব নেই। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজশাহী নগরের সাগরপাড়ার একটি ডাস্টবিনের সামনে

ময়লা কুড়িয়ে ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়েছেন, রাজশাহী শহরে জমি কিনেছেন

পিঠে ঝোলানো বড় একটি বস্তা। ডাস্টবিন থেকে এটা–ওটা তুলে নিয়ে বস্তায় রাখছেন। নারীর বয়স প্রায় ৪০ বছর। একই ডাস্টবিনে খাবার খুঁজছে একটি গরু ও একটি কুকুর। পথচারী, কুকুর বা গরু—কারও দিকেই ওই নারীর নজর নেই। নাম জিজ্ঞাসা করতেই যারপরনাই বিস্ময়ে মুখ তুলে চাইলেন। তাঁর নাম মনোয়ারা বেগম। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে মনোয়ারার সঙ্গে দেখা হয়েছিল রাজশাহী নগরের সাগরপাড়া মহল্লার একটি ডাস্টবিনে।

আলাপে আলাপে মনোয়ারা বলেন, তিনি রাজশাহী নগরের একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। বাসাভাড়া তিন হাজার টাকা। সকাল আটটায় একটি বস্তা নিয়ে বাসা থেকে বের হন। সারা দিন শহরের বিভিন্ন ডাস্টবিনে ঘুরে বেড়ান। বাসায় ফেরেন বিকেল চারটায়। রান্না করে যখন খেতে বসেন, তখন দুপুরের খাওয়ার সময় আর থাকে না। তাই আর রাতের খাবার আলাদা করে খাওয়া হয় না। ঘুমিয়ে পড়েন। বড় ছেলেকে সৌদি আরবে পাঠিয়েছেন। ছোট ছেলে একটি কারখানায় চাকরি করেন। মনোয়ারা স্বপ্ন দেখেন, ছেলে বিদেশ থেকে ফিরলে তাঁদের আর ভাড়া বাড়িতে থাকতে হবে না।

তারপরও কেন ডাস্টবিনে আসেন? প্রশ্ন করতেই মনোয়ারার চওড়া হাসি। তিনি বলেন, ‘ছেলেরা মানা করে। আমিই বইসে খাইতে পারি না।’

মনোয়ারার বাবার বাড়ি রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার নন্দগাছি এলাকায়। মা মারা গেছেন। বাবা আবার দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। তিন ভাই আছেন। তাঁরা তাঁদের মতো আলাদা সংসার করেন। কত দিন আগে মনোয়ারার বিয়ে হয়েছিল, ঠিক মেলাতে পারেন না। তবে তাঁর বড় ছেলের বয়স ২৬ বছর। স্বামীর নাম ছিল খোকন। তিনি ফরিদপুরের মানুষ ছিলেন। তাঁর পেশা ছিল স্বর্ণকারের দোকানের ছাই থেকে সোনা–রুপার সন্ধান করা।

মনোয়ারা বলেন, স্বামীর আয় খারাপ ছিল না। প্রতিদিন গড়ে হাজারখানেক টাকা আয় হতো। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ ছিল না। নেশা করে সব টাকা উড়িয়ে দিয়ে বাসায় ফিরতেন। বললেই মারধর করতেন। আজ থেকে ১৫ বছর আগে স্বামী মারা গেছেন। এর পর থেকে একাই সংসারের হাল ধরেছেন।

স্বামীর উড়নচণ্ডী স্বভাবের কারণে সংসারজীবনের শুরুতেই মানুষের বাসাবাড়িতে কাজ করতে শুরু করেছিলেন মনোয়ারা বেগম। তখন কাজ পাওয়া যেত না। শহরে নতুন এসেছিলেন। মানুষ চিনতেন না। কাজ দিত না। ভালো আয় হতো না। কীভাবে এই কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন জানতে চাইলে মনোয়ারা বলেন, ‘আমি যে মহল্লায় থাকি, সেখানে পার্বতীপুরের একটি মেয়ে থাকে। নাম আনু। ও ডাস্টবিন কুড়ায়। আমার দুঃখ দেখে একদিন কইল, আমার সঙ্গে চলো, ডাস্টবিন কুড়াই। বাসাবাড়ির চাইতে বেশি আয় হবে। ওর কথা বিশ্বাস কইরেই ডাস্টবিন কুড়াইতে আসি। আর ছাড়তে পারিনি।’

মনোয়ারা এই কাজ করেই বড় ছেলেকে এসএসসি পর্যন্ত লেখাপড়া শিখিয়েছেন। ছোট ছেলে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে। এখন শহরের একটি কারখানায় চাকরি করে। মাসে আট হাজার টাকা বেতন পায়। বড় ছেলে এসএসসি পাস করে বিদেশ গেছেন। কথা শুরু হওয়ার পর মনোয়ারাকে আর প্রশ্ন করতে হচ্ছে না। গড়গড় করে নিজের থেকেই সব বলে যাচ্ছেন।

মনোয়ারা বলেন, ছেলেকে বিদেশ পাঠাতে ৯ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। দালালের মাধ্যমে পাঠিয়েছেন। ছেলে লাখ টাকা বেতন পায়। আর দুই বছর পর ছেলে দেশে ফিরবে। এরপর খুশিতে গদগদ হয়ে মনোয়ারা যেন একটা গোপন কথা বলবেন, এমন ভাব করে গলাটা নামিয়ে বলেন, ‘এই শহরে আড়াই কাঠা মাটি কিনেছি, ভাইয়া। ছেলে ফিরলেই বাড়ি করব। আমি চাইছিলাম টিনের চালার একটা বাড়ি করি, কিন্তু ছেলে বলছে দেশে ফিরে ভিত দিয়ে বড় বাড়ি করবে।’ মনোয়ারার মুখ তখন খুশি আর হাসিতে একাকার।