আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ফরিদপুরের চারটি আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা পুরোদমে মাঠে কাজ শুরু করেছেন। তবে তাঁদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে দলীয় অন্তর্কোন্দল। নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এখনো সাংগঠনিক ভিত্তি রচনা করতে পারেনি ফরিদপুরে। নিজেদের মতো করে কাজ করে যাচ্ছে জামায়াতে ইসলামী।
জেলার চারটির মধ্যে তিনটি আসনেই বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী একাধিক নেতা আছেন। চারটি আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী ১৮ জন। জামায়াত চারটি আসনে তাদের চারজন নেতাকে দলীয় প্রার্থী হিসেবে প্রাথমিকভাবে বাছাই করেছে।
বোয়ালমারী, আলফাডাঙ্গা ও মধুখালী নিয়ে গঠিত ফরিদপুর-১ আসন। এ আসনে এলাকায় ব্যানার–পোস্টার সাঁটিয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য খন্দকার নাসিরুল ইসলাম ও বোয়ালমারী পৌর বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক শামসুদ্দীন মিয়া ওরফে ঝুনু। তাঁরা দুজন আলাদা করে নিজস্ব অনুসারীদের নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানও করছেন। এসব রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে একে অপরের প্রতি দোষারোপ, বিষোদ্গার ও আক্রমণ করে বক্তব্য রাখতে শোনা যাচ্ছে। অভ্যন্তরীণ কোন্দলে এই দুই নেতার সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে।
এই দুই নেতার বাইরে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা হলেন কেন্দ্রীয় যুবদলের সাবেক সহসভাপতি মনিরুজ্জামান, কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাবেক সদস্য জয়দেব কুমার রায়, কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. মাসুদুর রহমান, মধুখালী পৌর বিএনপির সাবেক সভাপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ ও বুয়েট ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ডেভিড সিকদার। এ আসনে জামায়াত তাদের প্রার্থী হিসেবে প্রাথমিক মনোনয়ন দিয়েছেন ইলিয়াস মোল্লাকে। তিনি ঢাকা জেলা জামায়াতের শুরা ও কর্মপরিষদ সদস্য।
নগরকান্দা ও সালথা উপজেলা নিয়ে গঠিত ফরিদপুর-২। বিএনপির মনোনয়ন চেয়ে কয়েক বছর ধরে দলীয় কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন বিএনপির প্রয়াত মহাসচিব কে এম ওবায়দুর রহমানের মেয়ে শামা ওবায়েদ ও একই উপজেলার শহীদুল ইসলাম। শামা বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও শহীদুল কৃষক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক। তবে ৫ আগস্টের পর এই দুই নেতার নানা কর্মকাণ্ডে অভ্যন্তরীণ কোন্দল ছড়িয়ে পড়ে। শহীদুল ও শামার সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে কৃষক দলের সমর্থক কবির ভূঁইয়া নিহত হন। এ ঘটনায় শামা ওবায়েদসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়। দুই নেতার দলীয় পদ স্থগিত করা হয়। পরে গত ১০ নভেম্বর দলীয় স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা হয়।
গত ফেব্রুয়ারিতে কেন্দ্রীয় বিএনপি থেকে শহীদুল ইসলামকে ফরিদপুর-২ আসনের পরিবর্তে ফরিদপুর-৪ আসনে কাজ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। এতে শামা ওবায়েদকে অনেকটা নির্ভার মনে হলেও তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দেখা দিতে পারেন নিজের চাচা নগরকান্দা উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি কে এম জাহাঙ্গীর। তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারেন ভাতিজির বিপক্ষে। কে এম জাহাঙ্গীর বলেন, ‘এ আসন থেকে নির্বাচন করার জন্য আমাকে চাপ দেওয়া হচ্ছে। চাপ দিচ্ছেন বিএনপির শামা ওবায়েদের বিরোধী পক্ষ। চাপ দিচ্ছে জামায়াত ও ইসলামী ঐক্যজোট।’ তিনি আওয়ামী লীগের সমর্থকদের অন্তত ৯০ শতাংশ ভোট পাবেন বলে আশাবাদী।
এ আসনে জামায়াতে ইসলামী নগরকান্দা উপজেলা জামায়াতের আমির ও নাজিম উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সোহরাব হোসেনকে বাছাই করেছে।
সদর উপজেলা নিয়ে গঠিত ফরিদপুর-৩ আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী তিনজন। তাঁরা হলেন জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য সৈয়দ মোদাররেছ আলী ইছা, কেন্দ্রীয় মহিলা দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী নায়াব ইউসুফ ও কেন্দ্রীয় যুবদলের সাবেক সহসভাপতি মাহবুবুল হাসান। নায়াব ইউসুফের বাবা প্রয়াত চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ ফরিদপুর-৩ আসন থেকে পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। বিএনপির শাসনামলে তিনি মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
নায়াব ইউসুফ বলেন, ‘আমার পরিবার মানুষের জন্য, মানুষের কল্যাণে রাজনীতি করে আসছে। আমি সে ধারার উত্তরাধিকারী। বাবাকে মানুষ যেভাবে স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা করেছে, আমিও তা পাব। আমার পরিবারের বড় একটা ভোটব্যাংক আছে। নিশ্চয়ই দল বিষয়গুলো মূল্যায়ন করে সিদ্ধান্ত নেবে।’
আগস্ট–পরবর্তী সময়ে নিজেকে সংসদ সদস্য হিসেবে দেখতে চেয়ে পোস্টার–ব্যানার ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার–প্রচারণায় সময় দিচ্ছেন জেলা বিএনপির আহ্বায়ক সৈয়দ মোদাররেছ আলী। তিনি ছাত্রজীবন থেকে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এবং এখন পর্যন্ত শক্ত হাতে এ ধারা বজায় রেখেছেন। তাঁর বাবা সৈয়দ মোশাররফ হোসেন জেলা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। সৈয়দ মোদাররেস আলী বলেন, ‘আজীবন বিএনপির রাজনীতি করেছি। আন্দোলন–সংগ্রামে কখনো পিছুপা হইনি।’
দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে আছেন যুবদলের কেন্দ্রীয় সাবেক সভাপতি মাহবুবুল হাসান। তিনি দাবি করেন, আন্দোলন–সংগ্রামে তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন। বিষয়টি দল মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই মূল্যায়ন করবে।
এ আসনে জামায়াতের প্রার্থী আবদুত তাওয়াব। তিনি জামায়াতের কেন্দ্রীয় শুরা সদস্য ও ফরিদপুর অঞ্চলের সদস্য।
ভাঙ্গা, সদরপুর ও চরভদ্রাসন নিয়ে ফরিদপুর-৪ আসন। বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্দেশে নিজের আসন (ফরিদপুর-২) ছেড়ে এসে এ আসনে ব্যাপক গণসংযোগ করে যাচ্ছেন কৃষক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম। তিনি বলেন, তিনি দীর্ঘ ৩৭ বছর ধরে বিএনপির রাজনীতি করছেন। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় হামলার শিকার হয়েছেন, মামলার শিকার হয়েছেন, কারাগারে গেছেন। তিনি এর মূল্যায়ন পাবেন বলে আশাবাদী।
দলের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চান জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জহিরুল হক শাহজাদা মিয়া। তিনি কয়েক বছর ধরে এ আসনে বিএনপির মনোনয়ন পাওয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। জহিরুল হক মনে করেন, দল তাঁর কর্মকাণ্ডের মূল্যায়ন করবে।
বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে আরও আছেন আইনজীবী মাহবুবুর রহমান ও কৃষক দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক আলমগীর কবির।
এ আসনে জামায়াতের প্রাথমিক মনোনয়ন পেয়েছেন মাওলানা সরোয়ার হোসেন। তিনি ভাঙ্গা উপজেলা জামায়াতের আমির ও তারাইল আলিম মাদ্রাসার শিক্ষক।
ফরিদপুরের চারটি আসনে এনসিপির কাউকে নির্বাচন সামনে রেখে মাঠপর্যায়ে কাজ করতে দেখা যায়নি বা কারও নাম শোনা যায়নি। এনসিপির ফরিদপুরের ভাঙ্গা কমিটি নিয়ে বিতর্ক উঠেছে। ভাঙ্গা উপজেলা কমিটি থেকে দুজন পদত্যাগ করেছেন প্রতিবাদ জানিয়ে, কমিটিতে সঠিক মূল্যায়ন হয়নি বলে। এ বিষয়ে এনসিপি ফরিদপুরের প্রধান সমন্বয়কারী সৈয়দা নিলিমা দোলা বলেন, ‘বর্তমানে আমরা জুলাইয়ের পদযাত্রা নিয়ে ব্যস্ত আছি। জুলাই আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ মাস। আমাদের জন্ম হয়েছে জুলাইয়ের চেতনা থেকে। পাশাপাশি দলীয় নিবন্ধন ও প্রতীক বরাদ্দের কাজ চলছে। জুলাই ও আগস্টের মধ্যে প্রয়োজনীয় এ কাজগুলো শেষ করে আগামী সেপ্টেম্বর মাস থেকে নির্বাচনের জন্য মাঠে নামবে এনসিপি।’