
নতুন জেটির নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে। কিন্তু প্যারাবন কাটার কারণে পরিবেশ অধিদপ্তর ও বন বিভাগের আপত্তির মুখে ছয় মাস কাজ বন্ধ ছিল। এরপর ‘জনস্বার্থের’ কথা বলে আবার কাজ শুরু হয়। স্থানীয় পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো এই নির্মাণকে ‘সরকারি অর্থের অপচয়’ বলে উল্লেখ করছে।
কক্সবাজারের মহেশখালীর গোরকঘাটা এলাকায় নতুন একটি জেটি নির্মাণের জন্য কাটা হয়েছে ২০ একরের প্যারাবনের হাজারো বাইনগাছ। এতে পাখি, কাঁকড়া, কাছিম, সাপ, মাছসহ অন্তত ২৬ প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে গেছে বলে দাবি করেছেন পরিবেশবাদীরা।
নতুন জেটি নির্মাণ করছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। প্রথমে রাস্তা, এরপর সেখানে নতুন জেটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। প্যারাবন উপকূলীয় বন বিভাগের এবং যে জায়গায় জেটি নির্মাণ করা হচ্ছে তা বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের ( বিআইডব্লিউটিএ) অধীন হলেও এই জেটি নির্মাণের আগে তাদের অনুমতি নেওয়া হয়নি।
১৯৮৯ সালে গোরকঘাটায় ৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয় একটি জেটি। ৬৯৫ মিটার দীর্ঘ এবং ৬ মিটার প্রস্থের ওই জেটির দুই পাশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ রোধে কয়েক শ একর প্যারাবন গড়ে তোলা হয়েছিল। বর্তমানে নতুন যে জেটি নির্মাণ করা হচ্ছে, সেটি ৭০০ মিটার দীর্ঘ এবং ৭ দশমিক ৩ মিটার প্রস্থের। এই প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৩০০ মিটার সংযোগ সড়কও রয়েছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জেটির নির্মাণকাজ শেষ করার কথা।
নতুন জেটির নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে। কিন্তু প্যারাবন কাটার কারণে পরিবেশ অধিদপ্তর ও বন বিভাগের আপত্তির মুখে ছয় মাস কাজ বন্ধ ছিল। এরপর ‘জনস্বার্থের’ কথা বলে আবার কাজ শুরু হয়। স্থানীয় পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো এই নির্মাণকে ‘সরকারি অর্থের অপচয়’ বলে উল্লেখ করছে।
বর্তমানে নতুন যে জেটি নির্মাণ করা হচ্ছে, সেটি ৭০০ মিটার দীর্ঘ ও ৭ দশমিক ৩ মিটার প্রস্থের। এই প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৩০০ মিটার সংযোগ সড়কও রয়েছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জেটির নির্মাণকাজ শেষ করার কথা।
বিআইডব্লিউটিএ-কক্সবাজার কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক খায়রুজ্জামান বলেন, গত ২৪ এপ্রিল কক্সবাজার এলে নৌপরিবহন ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন প্যারাবন কেটে এলজিইডির জেটির নির্মাণ কার্যক্রম পরিদর্শন করেন।
ঘটনাস্থলে উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, প্যারাবনের গাছপালা কেটে এ রকম একটি জেটি নির্মাণের আগে পরিবেশ অধিদপ্তর, বন ও বিআইডব্লিউটিএর অনুমতি নেওয়া প্রয়োজন ছিল। জেটি নির্মাণের জন্য এত গাছপালা কেটে ফেলার প্রয়োজন ছিল না।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে সরেজমিন দেখা গেছে, পুরোনো গোরকঘাটা জেটির কিছুটা দূরত্বে (পাশাপাশি) নতুন জেটির নির্মাণকাজ চলছে। জেটির জন্য কেটে ফেলা গাছের গোড়ালি এখনো পড়ে আছে।
পরিবেশবাদী সংগঠন ধরিত্রী রক্ষায় আমরার (ধরা) কক্সবাজার জেলা শাখার সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, ‘পুরোনো জেটি সচল থাকার পরও নতুন জেটি তৈরির নামে ২০ একরের প্যারাবনের অন্তত ১৫ থেকে ১৮ হাজার বাইনগাছ কেটে ফেলা হয়েছে। এতে জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে।’
‘পুরোনো জেটি সচল থাকার পরও নতুন জেটি তৈরির নামে ২০ একরের প্যারাবনের অন্তত ১৫ থেকে ১৮ হাজার বাইনগাছ কেটে ফেলা হয়েছে। এতে জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে।’—ফজলুল কাদের চৌধুরী, সভাপতি, কক্সবাজার জেলা শাখা, ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা)
তিনি অভিযোগ করেন, প্যারাবন ধ্বংস বন্ধের দাবিতে একাধিকবার মানববন্ধন ও প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করা হলেও কোনো সাড়া মেলেনি। বন বিভাগও কার্যত এখন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে।
বন বিভাগের তথ্যমতে, ২০০৩-০৪ অর্থবছরে গোরকঘাটা-আদিনাথ মন্দির এলাকায় প্রায় ৮০০ একর এলাকায় প্যারাবন সৃজন করা হয়। এ বিষয়ে উপকূলীয় বন বিভাগের মহেশখালী রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. আইয়ুব আলী বলেন, ‘জেটি নির্মাণে প্যারাবনের পাঁচ থেকে সাত হাজার গাছ কাটা হয়েছে। প্রথম দিকে আমরা বাধা দিয়েছিলাম, কিন্তু স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অনুরোধে সমঝোতায় আসা হয়। এখনো ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায়নি।’
নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ বিআইডব্লিউটিএর কক্সবাজার দপ্তরের সহকারী পরিচালক খায়রুজ্জামান জানান, জেটি নির্মাণের আগে পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিআইডব্লিউটিএর অনুমতি নেওয়া হয়নি।
বিআইডব্লিউটিএর উপপরিচালক (বন্দর) নয়ন শীল বলেন, ‘নদীপথ ও চরভূমিতে কোনো স্থাপনা নির্মাণে বিআইডব্লিউটিএর অনুমতি বাধ্যতামূলক। আমরা এলজিইডিকে কাজ বন্ধের অনুরোধ জানিয়েছিলাম। তারা তা মানেনি।’
জানতে চাইলে এলজিইডির মহেশখালী উপজেলা প্রকৌশলী বনি আমিন বলেন, পুরোনো জেটির অবস্থা খুবই খারাপ। তাই নতুন জেটি নির্মাণ অত্যন্ত জরুরি ছিল। এরই মধ্যে ৮০টি পিলারের মধ্যে ৭৮টির কাজ শেষ হয়েছে। ডিসেম্বরের মধ্যে নির্মাণ শেষ হবে। সরকার চাইলে পরে এটি বিআইডব্লিউটিএর অধীনে হস্তান্তর করা যাবে।
স্থানীয়ভাবে এই প্রকল্পকে জনস্বার্থের বদলে প্রভাবশালীদের স্বার্থ রক্ষার উদ্যোগ বলে মনে করছেন অনেকে। সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট, হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফোরামের (সিইএইচআরডিএফ) সহকারী প্রধান সমন্বয়ক রুহুল আমিন বলেন, ‘চিংড়িঘের নির্মাণের জন্য গত পাঁচ বছরে ছয় হাজার একরের প্যারাবন ধ্বংস করা হয়েছে। এর মধ্যে সোনাদিয়ায় ৪ হাজার একর এবং গোরকঘাটায় নতুন জেটির জন্য কাটা হয়েছে ১৫ হাজার গাছ।’
তিনি আরও বলেন, পুরোনো জেটি সংস্কার করলে ৩০ কোটি টাকা সাশ্রয় হতো। এই নতুন প্রকল্পটি অপ্রয়োজনীয় ও অপচয়মূলক।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কক্সবাজার জেলা প্রতিনিধি ও মহেশখালীর বাসিন্দা নুরুল আবছার বলেন, গোরকঘাটার পুরোনো জেটির আধা কিলোমিটার উত্তরে আদিনাথ মন্দিরের পাশে আরেকটি জেটি রয়েছে। দুই পাশের সবুজ প্যারাবনসমৃদ্ধ আদিনাথ জেটিটি নানা কৌশলে দীর্ঘকাল অচল রেখে স্পিডবোট ব্যবসা চাঙা করা হয়। সি-ট্রাক চালুর পর স্পিডবোট সিন্ডিকেট ভেঙে পড়ে। কক্সবাজার শহরের বাঁকখালী নদী থেকে যাত্রীবাহী স্পিডবোট আদিনাথ জেটিতে ভিড়লে গোরকঘাটার নতুন জেটির প্রয়োজনই ছিল না।