
চট্টগ্রামে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে বিএনপির অন্তত ৪০ জন নেতা-কর্মী মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। দলের প্রার্থীর বাইরে কোনো কোনো আসনে সর্বোচ্চ ৮ জন পর্যন্ত বিএনপির নেতা মনোনয়নপত্র নিয়েছেন। এতে ভোটের মাঠে প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন নেতা-কর্মীরা। তবে দলীয় নেতাদের দাবি, মনোনয়নপত্র নিলেও অনেকেই তা জমা দেবেন না, আর জমা দিলেও শেষ পর্যন্ত প্রত্যাহার করে নেবেন।
চট্টগ্রামের ১৫টি উপজেলা ও ৩৪টি থানা এলাকা নিয়ে মোট ১৬টি সংসদীয় আসন রয়েছে। এর মধ্যে নগরে ৪টি, উত্তরে ৭টি এবং দক্ষিণে ৫টি আসন। ১১ ডিসেম্বর তফসিল ঘোষণার পর তিনজন রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে মনোনয়নপত্র বিতরণ শুরু হয়। প্রার্থী হওয়ার শেষ সময় ২৯ ডিসেম্বর। গতকাল বুধবার পর্যন্ত চট্টগ্রামে মোট ১৪৪টি মনোনয়নপত্র বিতরণ হয়েছে।
চট্টগ্রামের ১৬টি আসনের মধ্যে বিএনপি এখন পর্যন্ত ১৪টিতে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। প্রার্থী ঘোষণার পর অন্তত ৭টি আসনে প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে আন্দোলন, মশালমিছিল ও সড়ক অবরোধের ঘটনাও ঘটে। এরপরও মনোনয়ন না পাওয়া নেতারা থেমে যাননি; তাঁরা মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন।
দলের নামে কিংবা স্বতন্ত্র হিসেবে বিএনপির মোট ৫৩ জন মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। এর মধ্যে দলীয় মনোনয়ন পাওয়া বিএনপির ১৩ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র নিয়েছেন। অর্থাৎ প্রায় ৭৫ শতাংশই দলীয় মনোনয়নের বাইরে।
‘ফাঁকা’ দুই আসনে প্রতিযোগিতা
চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা) ও চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ) আসনে এখনো প্রার্থী ঘোষণা করেনি বিএনপি। চট্টগ্রাম-১১ আসনে মনোনয়নপত্র নিয়েছেন বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপকমিটির সদস্য ইসরাফিল খসরু চৌধুরী। তিনি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর ছেলে। এ ছাড়া নগর বিএনপির সদস্যসচিব নাজিমুর রহমানসহ আরও কয়েকজন নেতা-কর্মী এ আসন থেকে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন।
ইসরাফিল খসরু প্রথম আলোকে বলেন, ‘১২ বছর ধরে এলাকায় কাজ করছি। বাকিটা দলের নীতিনির্ধারকদের বিষয়।’ অন্যদিকে নাজিমুর রহমান বলেন, ‘দল যে সিদ্ধান্ত নেবে, সেটিই মেনে নেব।’
চট্টগ্রামের ১৫টি উপজেলা ও ৩৪টি থানা এলাকা নিয়ে মোট ১৬টি সংসদীয় আসন রয়েছে। এর মধ্যে নগরে ৪টি, উত্তরে ৭টি এবং দক্ষিণে ৫টি আসন।
চট্টগ্রাম-১৪ আসনে দলের দক্ষিণ জেলা শাখার সাবেক সহসভাপতি মিজানুল হক চৌধুরী, চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি নাজিম উদ্দিন চৌধুরী, দক্ষিণ জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি শফিকুল ইসলাম মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। এ ছাড়া মনোনয়নপত্র নিয়েছেন বিএনপির কর্মী মোহাম্মদ ইখতিয়ার হোসেন, মোহাম্মদ আল হেলাল, এম এ হাশেম রাজু, মহসিন জিল্লুর করিম, এজাজ আহমদ চৌধুরী এবং জাকির হোসেন।
চার আসনে প্রার্থী বেশি
চট্টগ্রাম-১ (মিরসরাই) আসনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল আমিন। কিন্তু এ আসনে মনোনয়নপত্র নেন আরেক নুরুল আমিনও। তিনিও উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক। এ ছাড়া উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক শাহীদুল ইসলাম চৌধুরী এবং বিএনপির চেয়ারপারসনের সাবেক উপদেষ্টা এ এ জেড আমিন খানের ছেলে জিয়াদ আমিন খান মনোনয়নপত্র নিয়েছেন।
উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক শাহীদুল ইসলাম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘দল থেকে যাঁকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, সেটি চূড়ান্ত মনোনয়ন নয়। আমি দলের কাছে নানাভাবে আবেদন–নিবেদন করছি মনোনয়ন পেতে। তাই মনোনয়নপত্র নিয়েছি। দল থেকে শেষ পর্যন্ত চূড়ান্তভাবে যাঁকে মনোনয়ন দেবে, আমরা তাঁর পক্ষে কাজ করব।’
চট্টগ্রাম-৩ (সন্দ্বীপ) আসনে সাবেক সংসদ সদস্য মোস্তফা কামাল পাশাকে মনোনয়ন দিয়েছে দল। এর বাইরে ফরম নিয়েছেন উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক বেলায়েত হোসেন, যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা কামাল পাশা, কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাবেক সহসম্পাদক রফী উদ্দিন ফয়সাল এবং বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মো. তরিকুল আলম।
মনোনয়ন যে কেউ নিতে পারেন। অনেকে জমা দেবেন না। দিলেও প্রত্যাহার করে নেবেন। সবাই ধানের শীষের প্রার্থীর জন্য কাজ করবেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়েমাহবুবের রহমান, চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক, বিএনপি
চট্টগ্রাম-৯ (বাকলিয়া-কোতোয়ালি) আসনে নগর বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান দলীয় প্রার্থী। এই আসন থেকে নগর বিএনপির সাবেক সদস্যসচিব মো. আবুল হাশেম এবং কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মোহাম্মদ সামছুল আলম মনোনয়নপত্র নিয়েছেন। এ ছাড়া মনোনয়ন নিয়েছেন বিএনপি কর্মী বিপ্লব দে ও শাহজাদা মোহাম্মদ আহসান উল্লা খান।
চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনে দক্ষিণ জেলা বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক মোহাম্মদ এনামুল হক দলের প্রার্থী। এর বাইরে ফরম নিয়েছেন বিএনপি থেকে নির্বাচিত সাবেক সংসদ সদস্য গাজী মোহাম্মদ শাহজাহান, নগর ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি গাজী মোহাম্মদ সিরাজ উল্লাহ এবং বিএনপির কর্মী সৈয়দ সাদাত আহমেদ মনোনয়নপত্র নিয়েছেন।
পরিবর্তনের দাবি যেসব আসনে
চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) আসনে দলের প্রার্থী চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক সরওয়ার আলমগীর, উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক আজিম উল্লাহ বাহার এবং ছালাহ উদ্দিন নামে এক বিএনপি কর্মী ফরম নিয়েছেন। অন্যদিকে চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড) আসনে উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক কাজী মো. সালাউদ্দিনকে দলীয় মনোনয়ন দেয় বিএনপি। তবে ওই আসন থেকে বিএনপির সাবেক যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরী মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন।
চট্টগ্রাম-১৩ (আনোয়ারা-কর্ণফুলী) আসনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী সাবেক সংসদ সদস্য সরওয়ার জামাল নিজাম। এর বাইরে এ আসনে ফরম নিয়েছেন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আলী আব্বাস ও সদস্যসচিব হেলাল উদ্দিন। তাঁরা দুজন দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন।
চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসনে বিএনপির প্রার্থী দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদস্য নাজমুল মোস্তফা আমিন। একই আসন থেকে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক জামাল হোসেন ও মজিবুর রহমানও মনোনয়নপত্র নিয়েছেন।
এসব আসনে প্রার্থী ঘোষণার পর মশালমিছিল ও বিক্ষোভের ঘটনা ঘটেছিল। জানতে চাইলে দক্ষিণ জেলা বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আলী আব্বাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন আন্দোলন–সংগ্রামে ছিলাম। তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের চাপে মনোনয়নপত্র নিয়েছি। বাকিটা দলের সিদ্ধান্ত।’
বাকি আসনের হালচাল
চট্টগ্রাম-৫ (হাটহাজারী) আসনে বিএনপির মনোনয়ন পান দলের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন। একই আসন থেকে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এস এম ফজলুল হক এবং প্রয়াত বিএনপি নেতা ও সাবেক হুইপ সৈয়দ ওয়াহিদুল আলমের মেয়ে শাকিলা ফারজানা মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন।
চট্টগ্রাম-৬ (রাউজান) আসনে বিএনপির প্রার্থী কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান (পদ স্থগিত) গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী। এ ছাড়া এ আসনে ফরম নিয়েছেন উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক গোলাম আকবর খন্দকার।
চট্টগ্রাম-৮ (চান্দগাঁও-বোয়ালখালী) আসনে নগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহ দলের প্রার্থী। এ ছাড়া বিএনপির হয়ে ফরম নিয়েছেন মোহাম্মদ মহিবুল ইসলাম।
চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনে দলের প্রার্থী দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মিশকাতুল ইসলাম। স্বতন্ত্র হিসেবে ফরম নিয়েছেন দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক লেয়াকত আলী।
এ ছাড়া চট্টগ্রাম-১০ (ডবলমুরিং, পাহাড়তলী, হালিশহর ও খুলশী) আসনে দলের প্রার্থী বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও চট্টগ্রাম-৭ (রাঙ্গুনিয়া) আসনে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হুম্মাম কাদের চৌধুরী মনোনয়নপত্র নিয়েছেন।
দল থেকে প্রার্থী ঘোষণার পরও এক আসন থেকে একাধিক বিএনপির নেতা-কর্মীদের মনোনয়নপত্র নেওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মনোনয়নপত্র যে কেউ নিতে পারেন। অনেকে জমা দেবেন না। দিলেও প্রত্যাহার করে নেবেন। সবাই ধানের শীষের প্রার্থীর জন্য কাজ করবেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে।