নিজের লাগানো স্মৃতিবিজড়িত বটগাছটির দিকে বিষণ্ন মনে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন মো. শামীম। রোববার দুপুরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইবলিশ চত্বরে
নিজের লাগানো স্মৃতিবিজড়িত বটগাছটির দিকে বিষণ্ন মনে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন মো. শামীম। রোববার দুপুরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইবলিশ চত্বরে

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

নিজের লাগানো বটগাছটি হারিয়ে শামীম বললেন, প্রিয় কিছু হারালাম

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইবলিশ চত্বরে নিজের লাগানো বটগাছের নিচে ২৬ বছর ধরে চা বিক্রি করেন মো. শামীম। গতকাল শনিবার রাতের ঝোড়ো বাতাসে উপড়ে গেছে ক্যাম্পাসের স্মৃতিবাহী বটগাছটি।

বটগাছটি হারিয়ে বিষণ্ন শামীম। বেদনাতুর স্বরে বললেন, ‘প্রিয় কিছু হারালাম’। শুধু শামীম নন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও দর্শনার্থীদের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে বটতলার স্মৃতি।

বটগাছটা আমি নিজের হাতে লাগিয়েছিলাম। এত দিন ধরে এত বড় করলাম! কত ঠান্ডা হয়ে থাকত জায়গাটা। এত সুন্দর জায়গাটা তৈরি করলাম। খারাপ তো লাগবেই। এখন দুঃখ করলেই কী, কেউ তো পূরণ করে দিতে পারবে না।
মো. শামীম, ইবলিশ চত্বরের দোকানি
নিজের হাতে লাগানো বটগাছের তলায় শামীমের চায়ের দোকান। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইবলিশ চত্বরে

আজ রোববার সকাল সাতটার দিকে মো. শামীম দোকান খুলতে আসেন। দূর থেকে বটগাছটি পড়ে গেছে দেখতে পেয়েই মন খারাপ হয়ে যায় তাঁর। কথায় কথায় শামীম বলেন, ‘বটগাছটা আমি নিজের হাতে লাগিয়েছিলাম। এত দিন ধরে এত বড় করলাম! কত ঠান্ডা হয়ে থাকত জায়গাটা। এত সুন্দর জায়গাটা তৈরি করলাম। খারাপ তো লাগবেই। এখন দুঃখ করলেই কী, কেউ তো পূরণ করে দিতে পারবে না।’

৪০ বছরের বেশি সময় ধরে ক্যাম্পাসে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন শামীম। তিনি বলেন, ‘গাছটা উন্নত মানের ছিল। ক্যাম্পাসে এমন বটগাছ নাই। ২৫-২৬ বছরেই বিশাল আকারের হয়েছিল। আমি ছোট থেকেই ক্যাম্পাসে।’

দুঃখের মধ্যেও শামীম এক টুকরো সান্ত্বনা দিচ্ছেন এই ভেবে যে গাছটি পড়ে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তিনি বলেন, ‘দিনের বেলা গাড়ি থাকে, মানুষ বসে থাকে। দিনের বেলা পড়লে ক্ষতি হতো।’

দোকানের আশপাশে আরও কয়েকটি গাছ লাগিয়েছেন শামীম। তিনি বলেন, ‘তালগাছ ছাড়া সব গাছই আমার লাগানো। প্রথম পাকুড়গাছ লাগিয়েছিলাম। দোকানে রোদ পড়ত, এ জন্য পরে বটগাছ লাগিয়েছি। এটা সরিয়ে ফেললে আরেকটা বটগাছ লাগাব।’
আজ রোববার দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, বিশাল বটগাছটি শিকড়সহ উপড়ে আছে। ইবলিশের খেলার মাঠে পড়েছে গাছের ডালপালা ও পাতা। আশপাশের শিক্ষার্থী ও পথচারীরা থেমে থেমে বটগাছটির দিকে তাকাচ্ছেন, কেউ ছবি তুলছেন, কেউ আবার পুরোনো দিনের স্মৃতি মনে করে দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন।

আজ সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন এসে বটগাছটি দেখে গেছেন। নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে এক পোস্টে বটগাছের উপড়ে পড়া ছবি দিয়ে লিখেছেন, ‘গুড মর্নিং আরইউ! অ্যা স্যাড নিউজ, ইনডিড!’

পোস্টের কমেন্টে সিদ্দিকুর রহমান নামের এক শিক্ষার্থী লিখেছেন, ‘এই জায়গাটার প্রকৃত সৌন্দর্যই ছিল এই বটগাছ। বিশেষ করে গরমের দিনে ওখানে ভালো ছায়া পাওয়া যেত। শুধু এই গাছটার জন্য আমরা অনেকেই ওই জায়গার চায়ের দোকানটায় যেতাম। খারাপ লাগল দেখে। জায়গাটা এখন ফাঁকা ফাঁকা দেখাবে। আবার এমন বটগাছ হতে অনেক বছর লাগবে।’

শামীম আর বটগাছের গল্পটি ২০২৩ সালের ৯ মার্চ প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়েছিল ‘নিজের বটতলায় জীবন পার’ শিরোনামে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর বয়স ছিল চার বছর। ভাসতে ভাসতে এই বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে তাঁর ঠিকানা হয়েছিল। বাবার বাড়ি ছিল রাজশাহী শহরের পঞ্চপটীর পাঁচানীর মাঠের পাশে। খুব ছোট থাকতে ভেঙে যায় মা-বাবার সংসার। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মচারীর সঙ্গে তাঁর মায়ের আবার বিয়ে হয়। সেই থেকে তাঁর ঠিকানা এই বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর। নিজের হাতে লাগানো বটগাছের ছায়াতেই কেটেছে তাঁর জীবনের বড় একটি অংশ।