
নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার শিবগঞ্জ ঘাটে সোমেশ্বরী নদীর ওপর স্বেচ্ছাশ্রমে নির্মিত সেই কাঠের সেতুর আয় থেকে ৭১টি ধর্মীয়, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অর্থ বিতরণ করা হয়েছে।
গতকাল রোববার সন্ধ্যায় দুর্গাপুর প্রেসক্লাবে সেতু পরিচালনা কমিটির পক্ষ থেকে চেকের মাধ্যমে ১২ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়। আজ সোমবার সন্ধ্যায় আরও চারটি প্রতিষ্ঠানে চেক বিতরণ করার কথা আছে।
চেক বিতরণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সেতু পরিচালনা কমিটির সভাপতি এম এ জিন্নাহ, সদস্য মুফতি আবদুর রব, কুল্লাগড়া রামকৃষ্ণ আশ্রমের সাধারণ সম্পাদক প্রভাত চন্দ্র সাহা এবং খ্রিষ্টান মিশনারিজের প্রতিনিধি পংকজ সাংমা।
স্থানীয় বাসিন্দা ও সেতু পরিচালনা কমিটির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুর্গাপুর উপজেলার গাঁকান্দিয়া, কুল্লাগড়া, কাকৈইগড়া ও বিরিশিরি ইউনিয়নের আংশিক এলাকার প্রায় ৮০ হাজার মানুষের উপজেলা সদরের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের ব্যবস্থা ছিল না। সোমেশ্বরী নদীর ৯০০ মিটার প্রশস্ত অংশ ওই এলাকার মানুষের চলাচলে বাধা সৃষ্টি করত। এই দুর্ভোগ লাঘবে কেন্দ্রীয় বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামালের উদ্যোগে ও স্থানীয় লোকজনের স্বেচ্ছাশ্রমে গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর শিবগঞ্জ ঘাটে ৭৫০ ফুট দীর্ঘ কাঠের সেতু নির্মাণ করা হয়। এতে ব্যয় হয় ১৫ লাখ টাকা। সেতুটি নির্মিত হওয়ার পর থেকে স্থানীয় লোকজনের যাতায়াত সহজ হয়, পর্যটকদেরও সুবিধা হয়। রানীখং টিলার ক্যাথলিক মিশন, হাজংমাতা রাশিমণি স্মৃতিসৌধ কিংবা সোমেশ্বরীর স্বচ্ছ জলধারা দেখতে ভিড় বাড়ে স্থানীয় ও দূর থেকে আসা ভ্রমণপিপাসুদের।
সেতুটি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ছিল পরিচালনা কমিটির। যাত্রী, গবাদিপশু ও রিকশা-ভ্যান পারাপারে নামমাত্র ভাড়া নেওয়া হতো, তবে সাইকেল পারাপার ছিল বিনা মূল্যে। সংগৃহীত টাকা ব্যাংকে জমা রাখা হয় হিন্দু, মুসলিম ও খ্রিষ্টান ধর্মীয় নেতাদের যৌথ নামে।
এই কাঠের সেতু নিয়ে প্রথম আলোর ছাপা পত্রিকায় গত ৮ জানুয়ারি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল ‘সোমেশ্বরীর ওপর কাঠের সেতুটি এখন আশীর্বাদ’ শিরোনামে। তবে গত ১৫ মে পাহাড়ি ঢলের পানির স্রোতে অস্থায়ী সেতুটি ভেঙে যায়। তাতে আবারও শুরু হয় এলাকার মানুষের ভোগান্তি।
সেতুটি চালু হওয়ার সময় থেকে (গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর থেকে ১৫ মে পর্যন্ত) মোট ৫২ লাখ ৬৭ হাজার ৬৪০ টাকা আয় হয়। এর মধ্যে পরিচালনা, রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারে খরচ হয় ১২ লাখ ৪০ হাজার ৪০ টাকা এবং নির্মাণকাজে ১৫ লাখ ৪০ হাজার টাকা। সব ব্যয় বাদে অবশিষ্ট থাকে ২৪ লাখ ৮৭ হাজার ৬০০ টাকা।
এই অর্থের হিসাব প্রকাশ করে পরিচালনা কমিটি সংবাদ সম্মেলন করে, যা নিয়ে প্রথম আলোতে গত ১১ জুলাই ‘সেতু থেকে আয় ৫২ লাখ টাকা’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই অবশিষ্ট টাকা থেকেই এবার ১২ লাখ টাকা ধর্মীয়, শিক্ষা ও সেবামূলক কাজে বিতরণ করা হয়েছে।
সেতু পরিচালনা কমিটির সদস্য মো. ওয়ালি উল্লাহ, প্রভাত চন্দ্র সাহা ও পংকজ সাংমা বলেন, সেতুর আয় থেকে গতকাল কুল্লাগড়া রামকৃষ্ণ আশ্রমের অনাথালয় নির্মাণে ২ লাখ, দুর্গাপুর পৌর কবরস্থান উন্নয়নে ১ লাখ, ঝানজাইল, লক্ষ্মীপুর, মৌ ও দুর্গাপুর কাচারি মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন মসজিদ, মন্দির, গির্জা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন অঙ্কে মোট ১২ লাখ টাকা চেক দেওয়া হয়েছে। এতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধন আরও দৃঢ় হবে বলে তাঁরা আশা করেন।
কমিটির সভাপতি এম এ জিন্নাহ প্রথম আলোকে বলেন, স্বচ্ছতা বজায় রেখে সেতু পরিচালনা করা হয়েছে। সব খরচ বাদ দিয়ে যে আয় হয়েছে, তা স্থানীয় ধর্মীয় ও সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠানে ব্যয় করা হয়েছে। অবশিষ্ট টাকা দিয়ে আবারও একই পদ্ধতিতে অস্থায়ী সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা আছে।
বর্তমানে সেতুটি ভাঙা অবস্থায় আছে। তাই নৌকা দিয়েই সোমেশ্বরী পার হচ্ছেন স্থানীয় মানুষ। তাঁরা এখন স্থায়ী সেতু নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন।
কায়সার কামাল মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ধর্মীয় নেতাদের মাধ্যমে অত্যন্ত স্বচ্ছতার সঙ্গে অস্থায়ী সেতুটি পরিচালনা করা হয়। সমকালীন সময়ে তাঁরা এটা একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও আন্তরিকতা থাকলে এভাবে সব কাজই সহজে করা সম্ভব। সেতুটি নির্মাণ করায় অল্প সময়ের জন্য হলেও মানুষের কষ্ট লাঘব হয়েছিল।’