
কেউ বাসাবাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করেন, কেউবা ভ্যানচালক। কেউ প্রবাসে কাজ করেন, কেউ ব্যবসায়ী। তাঁদের মধ্যে গৃহিণী, কৃষক থেকে শুরু করে শিক্ষক, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও আছেন। তাঁরা কষ্টার্জিত অর্থ লাভের আশায় সমবায় সমিতি নামের ২৩টি প্রতিষ্ঠানে জমা করেছিলেন। কেউ এককালীন, কেউ মাসে মাসে টাকা জমা দিয়ে লাভের টাকা নিচ্ছিলেন। তবে এখন লাভ তো দূরের কথা, আসল টাকা ফিরে পাওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকেরা প্রায় দুই বছর ধরে আত্মগোপনে। গ্রাহকদের অভিযোগ, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর তুলনায় কয়েক গুণ বেশি মুনাফার লোভ দেখিয়ে জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলাসহ বিভিন্ন এলাকার ৩৫ হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে এক থেকে দেড় হাজার কোটি নিয়ে ২৩টি প্রতিষ্ঠানের মালিকেরা আত্মগোপনে চলে গেছেন।
আমানতের টাকা ফিরে পেতে আজ মঙ্গলবার সকালে প্রথমে মাদারগঞ্জ উপজেলা শহরের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে জড়ো হন কয়েক হাজার গ্রাহক। সেখানে সমাবেশের পর দুপুর ১২টার দিকে তাঁরা বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। মিছিলটি শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয় ঘেরাও করে। বেলা তিনটা পর্যন্ত তাঁরা ইউএনওর কার্যালয়ের সামনে অবস্থান করছিলেন। ‘মাদারগঞ্জে বিভিন্ন সমবায় সমিতিতে আমানতকৃত অর্থ উদ্ধারের জন্য সহায়ক কমিটি’ ব্যানারে তাঁরা এ কর্মসূচি পালন করছেন।
এ বিষয়ে কথা বলতে মাদারগঞ্জের ইউএনও নাদির শাহের মুঠোফোন নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি না ধরায় তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, সমবায় সমিতির মালিকেরা আত্মগোপনে যাওয়ার পর তাঁরা মাদারগঞ্জ থানা ও জামালপুরের আদালতে একাধিক মামলা করেছেন। জেলা প্রশাসক, জেলা সমবায় কার্যালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে একাধিকবার অভিযোগ দিয়েছেন। কিন্তু আমানতের টাকা উদ্ধারে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ন্যূনতম কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বাধ্য হয়ে তাঁরা আন্দোলনে নেমেছেন।
আমানতের অর্থ উদ্ধার কমিটির আহ্বায়ক শিবলুল বারী বলেন, বেশি মুনাফার লোভ দেখিয়ে সমিতির নামে প্রায় ৩৫ হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে এক থেকে দেড় হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। এখন মুনাফা তো দূরের কথা, আসল টাকা দিতে টালবাহানা করছেন সমিতির উদ্যোক্তারা। টাকা উদ্ধারে দীর্ঘদিন ধরে গ্রাহকদের স্বাক্ষর সংগ্রহ, মানববন্ধন, স্মারকলিপি, সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিলসহ নানা কর্মসূচি করে করে আসছেন গ্রাহকেরা। কিন্তু প্রশাসন ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের ন্যূনতম সহযোগিতা করছে না।
জেলা সমবায় কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, মাদারগঞ্জে ১৬৩টি সমিতির নিবন্ধন আছে। ২০২২ সাল থেকে বিভিন্ন কারণে ৭৪টি সমিতির কার্যক্রম বন্ধের পথে। উদ্যোক্তারা প্রায় কার্যক্রম বন্ধ করে আত্মগোপনে চলে গেছেন। এসব সমিতির মধ্যে ২৩টিকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে জেলা সমবায় কার্যালয়। ২৩টি সমিতির উদ্যোক্তাদের কাছে প্রায় ৩৫ হাজার গ্রাহকের ৭৩০ কোটি টাকা থাকার কথা বলা হয়েছে।
ভুক্তভোগী গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২৩টি সমিতির মধ্যে আল-আকাবা, শতদল, স্বদেশ, নবদীপ, হলিটার্গেট ও রংধুন অন্যতম। ছয়টি সমিতির কাছে জমা আছে ৭০০ কোটি টাকার বেশি। শুধু মাদারগঞ্জের ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের একটি হিসাব করে দেখা গেছে, প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা সমিতিগুলোতে আছে। এ ছাড়া ইসলামপুর, মেলান্দহ, সরিষাবাড়ী ও জামালপুর সদরের কয়েক হাজার গ্রাহক আছেন। ফলে টাকার পরিমাণ ২ হাজার কোটি টাকার বেশি হবে।
জেলা সমবায় কর্মকর্তা মো. আবদুল হান্নান প্রথম আলোকে বলেন, গ্রাহকদের আজকের কর্মসূচির ব্যাপারে শুনেছেন। তবে তাঁর হাতে টাকা উদ্ধার করে দেওয়ার মতো ক্ষমতা নেই। তিনি জেলায় এসে জেনেছেন, সমিতিগুলোর উদ্যোক্তারা পালিয়ে গেছেন। এর পর থেকে তিনিও বিভিন্নভাবে উদ্যোক্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এখন উদ্যোক্তাদের নম্বরও বন্ধ। এখন তাঁর কিছুই করার নেই। প্রশাসন যদি কিছু করে, তাহলে কিছু একটা হতে পারে।
২৩টি সমিতির মধ্যে আল-আকাবা বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি হুমায়ুন আহম্মেদ, শতদল বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি মো. মোস্তাফিজ, স্বদেশ বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি আনিছুর রহমান ও নবদীপ সমবায় মিতির সভাপতি ইব্রাহিম খলিল দীর্ঘদিন ধরে আত্মগোপনে আছেন। তাঁদের মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগ করে বন্ধ পাওয়ায় তাঁদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।