
মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন টাঙ্গাইলের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। এর মধ্যে ষাটের দশকের তিন কবি রণাঙ্গনে রেখেছেন অনন্য ভূমিকা। তাঁরা রণাঙ্গনে যেমন অস্ত্র চালিয়েছেন, আবার লিখেছেন কবিতাও। বিজয় অর্জনের পর তাঁদের কাব্যচর্চাতেও উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি। রণাঙ্গনে সরাসরি অংশ নেওয়া টাঙ্গাইলের তিন বীর মুক্তিযোদ্ধা কবি হলেন বুলবুল খান মাহবুব, রফিক আজাদ ও মাহবুব সাদিক।
মুক্তিযুদ্ধকালীন কাদেরিয়া বাহিনীর প্রশাসক আবু মোহাম্মদ এনায়েত করিমসহ স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৭১ সালে ভাসানী ন্যাপের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কবি বুলবুল খান। স্বাধিকার আন্দোলনের শুরুতে তাঁর নেতৃত্বে টাঙ্গাইলে বামপন্থী রাজনীতিবিদদের সমন্বয়ে বিপ্লবী হাইকমান্ড গঠন করা হয়। তাঁরা এই কমান্ডের অধীনে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। ৩ এপ্রিল টাঙ্গাইলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢুকে পড়ে। ওই দিন বুলবুল খান তাঁর অনুসারীদের নিয়ে শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে চলে যান। সঙ্গে নিয়ে যান সংগ্রহ করা কিছু অস্ত্র। প্রথমে স্বতন্ত্রভাবে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন বুলবুল খান। পরে ছাত্রলীগের তৎকালীন নেতা আবদুল কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কাদেরিয়া বাহিনী গঠিত হয়। তখন বুলবুল খান ওই বাহিনীতে যুক্ত হয়ে যুদ্ধে অংশ নেন।
কাদেরিয়া বাহিনীর সদর দপ্তর ছিল সখীপুর উপজেলা বনাঞ্চলে মহানন্দপুরে। কবি মাহবুব সাদিক শুরুতেই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তখন তিনি কলেজের তরুণ শিক্ষক। কাদেরিয়া বাহিনীর সদর দপ্তরে তিনি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তাঞ্চল থেকে কাদেরিয়া বাহিনী মুখপাত্র ‘রণাঙ্গন’ নামের একটি পত্রিকা বের করা হয়। ওই বাহিনীর বেসামরিক প্রধান আনোয়ার-উল-আলম শহীদ ওই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। হাতে লেখা ওই পত্রিকার অধিকাংশ কাজই করতেন কবি মাহবুব সাদিক। এদিকে যুদ্ধ শুরুর কয়েক মাস পর প্রখ্যাত কবি রফিক আজাদ সখীপুর উপজেলার মহানন্দপুর গ্রামে যান। তিনি সেখানে গিয়ে কাদেরিয়া বাহিনীর সঙ্গে সম্পৃক্ত হন।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণা করে কবি বুলবুল খান প্রথম আলোকে জানান, ১১ আগস্ট মুক্তিযোদ্ধারা টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে যমুনা নদীতে পাকিস্তানি হানাদারদের অস্ত্রবাহী একটি জাহাজে আক্রমণ করেন। সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধারা দখলে নেন। পরে টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ শুরু হয়। বাহিনীর প্রধান কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে বুলবুল খান ভূঞাপুর থেকে ঘাটাইলের দিকে চলে যান। সেখানে যুদ্ধে গুরুতর আহত হন খোরশেদ আলম বীর প্রতীক। আহত খোরশেদ আলমকে নিয়ে বুলবুল খান ও তাঁর ১০ জন সহযোদ্ধা সখীপুর কাদেরিয়া বাহিনীর সদর দপ্তরে রওনা হন। রক্তাক্ত খোরশেদ আলমকে বাঁশের স্ট্রেচারে তুলে সহযোদ্ধারা কাঁধে করে প্রায় ৩০ মাইল পথ হেঁটে সেখানে পৌঁছান। সেখানেই তিন কবি বুলবুল খান মাহবুব, রফিক আজাদ ও মাহবুব সাদিকের মিলন ঘটে।
আহত খোরশেদ আলমকে নিয়ে যাওয়ার অনুভূতি থেকে বুলবুল খান যুদ্ধক্ষেত্রে রচনা করেন ‘জখমী সাথীকে নিয়ে আমরা দশ জন’ শীর্ষক কবিতা। ওই কবিতায় তিনি লিখেছেন ‘এবার আমরা হাতিয়ার হাতে নেবো/ রক্তের ঋণ রক্তেই শোধ দেবো।’
বিজয় অর্জনের পর ‘জখমী সাথীকে নিয়ে আমরা দশ জন’ এই নামেই মুক্তিযুদ্ধকালীন লেখা কবিতাগুলো নিয়ে বুলবুল খান গ্রন্থ প্রকাশ করেন। কবি মাহবুব হাসান মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে অসংখ্য কবিতা লিখেছেন। এসব কবিতা স্থান পেয়েছে তাঁর ‘যুদ্ধভাসান’ কাব্যগ্রন্থে। কবি রফিক আজাদের কবিতায়ও এসেছে মুক্তিযুদ্ধের কথা। তিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন স্মৃতি নিয়ে লিখেছেন ‘স্মৃতিময় সখীপুর’ নামে কবিতা। ‘মাথার ওপরে সারা দিন অবিশ্রান্ত পাকি-কপ্টার ঘোরে/ শনাক্ত করতে চায় আমাদের অবস্থান/ ঘন গাছপালা-ঘেরা সখীপুর-সদর দপ্তর।’ তাঁর একাধিক কবিতায় উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি।
কবি মাহবুব সাদিক যুদ্ধ শেষে বিজয় অর্জনের পর আবার ফিরে যান শিক্ষকতায়। তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ তিনি টাঙ্গাইলের করটিয়ার সরকারি সা’দত কলেজের অধ্যক্ষ হয়েছিলেন। এখন অবসরে আছেন। মাহবুব সাদিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের তিনজনেরই জীবন ঝুলে ছিল সুচ-সুতায়। কাগজে-কলমে কবিতা লেখার অবকাশ তখন ছিল না তেমন। যদিও তখন ফাঁক পেলে কবিতা লিখেছি। মধ্য একাত্তরে রণাঙ্গনে বসে “বঙ্গদেশ” শীর্ষক কবিতায় লিখেছি “স্বস্তির দেয়ালে আজ উল্কি আঁকে উদ্বেগের তুলি...”। ওই সময় কবিতার হাজার হাজার উপাদান মগজে জমেছিল। কাল ও জীবনসংকটের নানা মাত্রা জমা হয়েছিল মগজের কোষে কোষে। অস্তিত্বের সংকটকালে কবির চেতনা হয় আরও ধারালো, আরও ক্ষুরধার। সেই ক্ষুরধার চেতনা ও দেশপ্রেমের অকৃত্রিম আবেগ আমি লক্ষ করেছি রফিক আজাদ আর বুলবুল ভাইয়ের মধ্যেও।’
মুক্তিযুদ্ধকালীন কাদেরিয়া বাহিনীর প্রশাসক আবু মোহাম্মদ এনায়েত করিম বলেন, টাঙ্গাইলের মুক্তিযুদ্ধে কবি বুলবুল খান মাহবুব, রফিক আজাদ ও মাহবুব সাদিক অংশ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। দেশকে মুক্ত করতে তাঁরা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন। পাশাপাশি লিখেছেন কবিতাও।
টাঙ্গাইল সাহিত্য সংসদের সভাপতি কবি মাহমুদ কামাল বলেন, এই তিন কবি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে দেশের স্বাধীনতা অর্জনে ভূমিকা রেখেছেন। যুদ্ধক্ষেত্রে এবং বিজয়ের পরও তাঁদের কবিতায় উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের কথা; মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব ও ত্যাগের কথা।