
কাঠের তৈরি ছোট ট্রলারকে অবৈধভাবে যান্ত্রিক ‘ট্রলিং ট্রলারে’ রূপান্তর করা হয়। যুক্ত করা হয় ছোট ফাঁসের ‘বেহুন্দি জাল’। এর মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরের বুকে চলছে নীরব এক ধ্বংসযজ্ঞ। আধা ইঞ্চি ফাঁসের জালে ধরা পড়ছে গভীর ও অগভীর সাগরের রেণু, ডিমওয়ালা মা মাছ ও মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য। এই চর্চার ফলে গত তিন বছরে আশঙ্কাজনকভাবে কমেছে মাছের প্রজনন। ভেঙে পড়ছে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য।
জেলে ও ট্রলারমালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলা থেকেই অবৈধ ট্রলার রূপান্তরের যাত্রা শুরু হয়। স্থানীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে ট্রলারমালিক মাসুম আকনের মালিকানাধীন দুটি কাঠের ট্রলারে প্রথমে যান্ত্রিক জাল টানার ব্যবস্থা বসানো হয়। এরপর একে একে আরও অনেক ট্রলারমালিক এই পথে হেঁটেছেন। বর্তমানে শুধু পাথরঘাটায় অন্তত ৩৮টি ট্রলারে ছোট ফাঁসের বেহুন্দি জাল দিয়ে সাগরে অবৈধভাবে মাছ শিকার করছে। এ প্রবণতা পটুয়াখালীর মহিপুর, ভোলার বিভিন্ন উপজেলা ও চট্টগ্রামের কুতুবদিয়ার কাঠখালী পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে।
মহিপুর মৎস্য বন্দরের ব্যবসায়ী মো. মজনু গাজী প্রথম আলোকে বলেন, একটি সাধারণ কাঠের ট্রলারকে ট্রলিং ট্রলারে রূপান্তর করতে ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা ব্যয় হয়। এসব ট্রলারে যে ধরনের বেহুন্দি জাল ব্যবহার করা হয়, তাতে পানি ছাড়া আর কিছুই বের হতে পারে না। এতে মাছের পোনা, ডিম, এমনকি মাছের খাবার পর্যন্ত ধ্বংস হয়। এ ট্রলার বন্ধ না হলে নদ–নদী ও সাগর মাছশূন্য হয়ে পড়বে।
মজনু গাজী জানান, বর্তমানে পাথরঘাটায় অন্তত ৫০টি, মহিপুরে ৭০টির মতো, ভোলায় ৯০টি ও চট্টগ্রামের কাঠখালী এলাকায় ২০০টির কাছাকাছি এ ধরনের রূপান্তরিত অবৈধ ট্রলার আছে। তাঁর নিজেরও এই ট্রলার বানাতে দাদন দেওয়া থাকলেও তিনিও এই ট্রলার নিষিদ্ধ হোক, সেটা চান।
পাথরঘাটার কালমেঘা গ্রামের জেলে আবদুস ছত্তার বলেন, ‘মোরা বৈধ ট্রলার লইয়্যা সাগরে যাই। কিন্তু আগের মতোন আর মাছ জালে ওডে না। সব মাছ-পোনা ট্রলিং বোট পানি ছেইক্কা ধইর্যা হালায়। মোগো যে কি পালা অইবে কইতে পারি না।’
কয়েকজন ট্রলারমালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রূপান্তরের জন্য এসব ট্রলারের ইঞ্জিনকক্ষের ওপর বড় আকারের স্টিল কাঠামো তৈরি করা হয়। এরপর হাইড্রোলিক বা গিয়ারচালিত উইঞ্চ সংযোজন করা হয়, যা দিয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জাল তোলা ও ফেলা যায়। সঙ্গে বসানো হয় পুলি, দড়ি, চাকা ও শক্তিশালী ডিজেলচালিত জেনারেটর। মাছের অবস্থান নির্ণয়ের জন্য মুঠোফোন অ্যাপভিত্তিক জিপিএস ব্যবহার করা হয়। ৪০ মিটার গভীরতায় না পৌঁছাতে পারায় এসব ট্রলার উপকূলীয় অগভীর এলাকায় জাল ফেলে এবং ছোট ফাঁসের বেহুন্দি জাল দিয়ে রেণু, ডিম, পোনা—সব ধ্বংস করছে।
ট্রলার রূপান্তরের কাজ স্থানীয় ওয়ার্কশপেই হচ্ছে। চট্টগ্রাম থেকে প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ এনে প্রতিটি এলাকায় এখন এ কাজ করা হচ্ছে। অধিক লাভের আশায় গভীর সমুদ্রগামী ট্রলারমালিকেরা দ্রুত এ রূপান্তরের পথে ঝুঁকছেন। পাথরঘাটার ট্রলার ব্যবসায়ী মাসুম আকন ও সগির হোসেন ছিলেন রূপান্তরের অগ্রদূত। তাঁদের দেখাদেখি গোটা উপকূলজুড়ে এ প্রবণতা ছড়িয়ে পড়েছে।
জানতে চাইলে মাসুম আকন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্তমানে আমার আটটি ট্রলার আছে। সবই এ ধরনের। পাথরঘাটায় এ ধরনের ৩৮টির মতো ট্রলার চলছে।’ তিনি বলেন, ২০২৩ সালের শেষের দিকে তাঁরা উচ্চ আদালতে রিট করে ছয় মাসের অনুমোদন পান এবং পরে তা আরও কয়েক দফায় নবায়ন হয়েছে। মাছ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘মৎস্য বিভাগ যদি বলত এ সময়ের মধ্যে ট্রলার বন্ধ করতে হবে, আমরা করতাম। বহুবার সভা করেছি। তাঁরা কখনো এমন কিছু বলেনি।’ সগির হোসেনের মুঠোফোন বন্ধ পাওয়ায় তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
ট্রলিং ট্রলারগুলোয় বসানো যান্ত্রিক জাল মূলত সমুদ্রের তলদেশ ঘেঁষে টানা হয়। এতে শুধু মাছই ধরা পড়ে না। বরং সাগরের নিচে থাকা শামুক, ঝিনুক, সামুদ্রিক শৈবাল, প্রবাল, সাগরঘাসসহ সবকিছু উঠে আসে। অথচ এসব উপাদান মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য এবং ডিম ছাড়ার নিরাপদ আশ্রয়।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বলছে, যান্ত্রিকভাবে টানা জালপদ্ধতি গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার সবচেয়ে বিধ্বংসী উপায়গুলোর একটি। এটি সাগরের তলদেশের পরিবেশকে ধ্বংস করে দেয়, যা মাছের বংশবৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ইলিশ–জাতীয় মাছ সাধারণত নদী মোহনা ও অগভীর সাগরেই ডিম ছাড়ে। কিন্তু রূপান্তরিত ট্রলারগুলোর জাল যখন সেই অগভীর স্তরে চলে যায়, তখন ডিমওয়ালা মা মাছ, রেণু ও ছোট মাছ ধরা পড়ে। ফলে প্রাকৃতিক প্রজনন ব্যাহত হয়। আন্তর্জাতিক গবেষণা ও পরিবেশ সংস্থাগুলোর মতে, যান্ত্রিক পদ্ধতিতে লক্ষ্য শুধু মাছই নয়—অনাকাঙ্ক্ষিত বহু উপকারী প্রাণীও ধরা পড়ে, যা পুরো সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থানের ভারসাম্য ধ্বংস করে দেয়।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকুয়াকালচার বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মীর মোহাম্মদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, সম্প্রতি তিনি মহিপুর, আলীপুর ও পাথরঘাটা এলাকায় ট্রলির ট্রলারের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে কাজ করেছেন। দেশে প্রচলিত শিল্পভিত্তিক ট্রলিং জাহাজ ৪০ মিটার গভীরতায় মাছ ধরার অনুমতি পেলেও এসব রূপান্তরিত ট্রলার ৬ থেকে ৮ মিটার গভীরতায় ছোট ফাঁসের বেহুন্দি জাল দিয়ে মাছ ধরছে। এটা অবিলম্বে বন্ধ না হলে দেশের মৎস্যভান্ডার ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।
অবৈধ ট্রলারের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছে না মৎস্য বিভাগ। এর পেছনে মূল কারণ আইনি ফাঁকফোকর। রূপান্তরিত এসব ট্রলিং ট্রলারমালিকেরা অবৈধ ট্রলারের বৈধতা দাবি করে আদালতে রিট করে। রিট চলমান থাকায় এসব ট্রলারের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে পারে না মৎস্য বিভাগ।
ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের পরিচালক মোল্লা এমদাদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ট্রলারগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু মালিকপক্ষ বেহুন্দি জালের লাইসেন্স নিয়ে ট্রলারে বসিয়ে নেয়। পরে রিট করে নৌযানের বৈধতা চায়। রিট নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা কিছু করতে পারেন না। তাঁরা সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারেন। ট্রলারমালিকেরা জরিমানার অর্থ অনায়াসে দিয়ে দেন। কারণ, এ ধরনের ট্রলার থেকে মাসে কোটি কোটি টাকা তাঁরা অবৈধভাবে আয় করেন।