‘আমাদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো নিয়ে অনেক মানুষের একটা নেতিবাচক ধারণা আছে যে এখানে পড়াশোনা হয় না, মান ভালো না। কিন্তু এখানের পরিবেশ সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানকার শিশুদের পড়ালেখার পরিবেশ, কো-কারিকুলার অ্যাকটিভিটিস দেখে এবং শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে আমি মুগ্ধ হয়েছি। এটা নামে যেমন একটা মডেল স্কুল, কাজেও তেমনি মডেল স্কুল। আমাদের বিদ্যালয়গুলোর পরিবেশ এমনই হওয়া উচিত।’
মাগুরার শালিখা উপজেলার আড়পাড়া মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নিয়ে এ মন্তব্য করেছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার। গতকাল রোববার সকালে বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করেন উপদেষ্টা।
ইস্টার সানডে উপলক্ষে এদিন ছুটি থাকলেও শিশুদের বিদ্যালয়ে আসতে বলেছিলেন শিক্ষকেরা। উপদেষ্টার পরিদর্শন উপলক্ষে শিক্ষার্থীরা কুচকাওয়াজ পরিবেশন করে। এরপর বিদ্যালয়ের বিভিন্ন কার্যক্রম ঘুরে দেখেন উপদেষ্টা। শিক্ষার্থীদের কুচকাওয়াজের একটি ভিডিও পরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভেরিফায়েড ফেসবুকে শেয়ার করা হয়। প্রথম ছয় ঘণ্টায় প্রায় এক লাখ মানুষ ওই ভিডিও দেখেছেন। অনেকেই বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রশংসা করে মন্তব্যও করেছেন।
উপদেষ্টাকে মুগ্ধ করা প্রাথমিক বিদ্যালয়টি সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, নানা রকম অভিনব উদ্যোগ নেওয়ায় বিদ্যালয়টি ২০১৭ সালে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে পুরস্কার পায়। একই বছরে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইয়াসমিন আক্তারও শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক হিসেবে পদক পান। ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত শালিখা উপজেলা সদরে অবস্থিত এই বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের চাপ ক্রমেই বেড়েছে। বর্তমানে প্রাক্-প্রাথমিক, প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে ৩৯৯ জন বালক ও ৩৮৭ জন বালিকাসহ ৭৮৬ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। শিক্ষক আছেন ১৪ জন।
সরেজমিন দেখা যায়, বিদ্যালয়ের ছোট চত্বরকে নানা রঙে সাজানো হয়েছে। সেখানে অল্প জায়গার মধ্যে অভিভাবকদের বসার জায়গা, ফুলের বাগান, শিশুদের নানা রকম খেলার উপকরণে সাজানো হয়েছে। প্রতিটি শ্রেণিকক্ষের নামকরণ করা হয়েছে বিখ্যাত সব ব্যক্তির নামে। শ্রেণিকক্ষগুলো এমনভাবে সাজানো হয়েছে যেন মনে হয় খেলার জায়গা। এখানকার শিশুদের বিদ্যালয়ের পোশাকেও রয়েছে ভিন্নতা। ছেলে–মেয়েদের শার্ট, স্কার্ট, প্যান্ট ও পাজামার সঙ্গে সবার রয়েছে বিশেষ ধরনের টুপি।
সরকার নির্দেশিত শিক্ষা কার্যক্রমের পাশাপাশি আড়পাড়া মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কিছু উদ্ভাবনী চর্চা করা হয়। এখানকার শিশুদের জন্য ‘স্কুল ডিজিটাল সার্ভিস পয়েন্ট’ নামে একটি জায়গা নির্ধারিত আছে। যেখানে একটি কম্পিউটার রয়েছে শিশুদের ব্যবহারের জন্য। এর পাশেই রয়েছে একটি টেলিফোন। যেটা শিশুদের ব্যবহারের জন্য। এই টেলিফোন দিয়ে প্রয়োজনে শিশুরা তাঁদের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলতে পারে। ‘এই দিনে’ নামক তথ্য বোর্ড রয়েছে বিদ্যালয়ে। প্রতিদিনের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে এটি তৈরি করা হয়। সমাবেশে তথ্যটি নির্ভুলভাবে বলতে পারা শিশুকে ওই দিন দেওয়া হয় ‘আজকের শিশু বা স্টুডেন্টস অব দ্য ডে’ মেডেল। এর মাধ্যমে প্রতিদিন শিশুরা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতে পারে।
শিক্ষকেরা জানান, বিদ্যালয়ের প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে রয়েছে সিসি ক্যামেরা ও সাউন্ড সিস্টেম। এর মাধ্যমে প্রধান শিক্ষক প্রতিটি শ্রেণিকক্ষ পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি একই সঙ্গে সব কক্ষে প্রয়োজনীয় বার্তা দিতে পারেন। এ ছাড়া ২০১৫ সাল থেকে এই বিদ্যালয়ে চালু রয়েছে ‘অনেস্টি শপ ৭৬২০’ নামের দোকান। যেখান থেকে শিশুরা দোকানদার ছাড়াই টাকা দিয়ে জিনিসপত্র কিনতে পারে। বিদ্যালয়ের রয়েছে ‘মহানুভবতার দেয়াল’ নামে নির্দিষ্ট একটি জায়গা। যেখানে শিশুদের অতিরিক্ত কাপড়, স্কুল ড্রেস, জুতা রেখে দেয়। প্রয়োজন হলে অন্যরা সেটা আবার সংগ্রহ করে নেয়। অভিভাবকদের বসার জায়গায় রয়েছে ‘অভিভাবক আনন্দ পাঠাগার’ একটি উদ্যোগ।
শিক্ষকেরা জানান, এখানে অভিভাবকদের জন্য শিশুতোষ কিছু বই রাখা হয়। যেন তাঁরা এটি পড়ে নিজেরা আনন্দ পান, আবার সেই গল্প বাড়িতে গিয়ে শিশুদের শোনাতে পারেন। ‘আলোকিত আচরণ সংগ্রহশালা’ নামে রয়েছে আরও একটি উদ্যোগ। যেখানে শিশুদের ইতিবাচক আচরণকে অনুপ্রাণিত করতে, কোনো শিশু ভালো কাজ করলে তার ছবি ওই বোর্ডে টাঙিয়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া ডিজিটাল ঘণ্টা, টিফিনের টাকা সঞ্চয় বাক্স, মেয়েদের জন্য স্যানিটারি ন্যাপকিনসহ নানা রকম অভিনব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এই বিদ্যালয়ে।
এসব উদ্যোগের জন্য ২০১৭ সালে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইয়াসমিন আক্তারও শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষকের পদক পান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটা সুন্দর স্কুলের স্বপ্ন ছিল। দায়িত্ব নেওয়ার পর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করেছি সবাইকে সঙ্গে নিয়ে। এ কাজে শিক্ষক, অভিভাবক, প্রশাসন—সবাই সহযোগিতা করেছেন। আমি স্কুলকে ভালোবেসেছি। আমি আমার কাজকে ভালোবেসেছি। ব্যতিক্রম আইডিয়া কাজে লাগিয়ে কীভাবে স্কুলকে সময়োপযোগী করা যায়, সেটা নিয়েই রাতদিন ভেবেছি, পরিশ্রম করেছি। এভাবেই এ অবস্থানে আসতে পেরেছি আমরা।’
বিদ্যালয়টি পরিদর্শনের সময় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ আতিকুর রহমান, জেলা প্রশাসক মো. অহিদুল ইসলাম, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগের উপপরিচালক শফিকুল ইসলাম, মাগুরা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আমিরুল ইসলাম, শালিখা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বনি আমিন প্রমুখ।