বরগুনায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার কারণ অনুসন্ধানে তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহ করেছে আইইডিসিআরের ৬ সদস্যের প্রতিনিধি দল। গত মঙ্গলবার দুপুরে বরগুনা জেনারেল হাসপতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের সঙ্গে কথা বলেন প্রতিনিধি দলের সদস্যরা
বরগুনায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার কারণ অনুসন্ধানে তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহ করেছে আইইডিসিআরের ৬ সদস্যের প্রতিনিধি দল। গত মঙ্গলবার দুপুরে বরগুনা জেনারেল হাসপতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের সঙ্গে কথা বলেন প্রতিনিধি দলের সদস্যরা

বরগুনায় সরকারি হিসাবের বাইরেও ডেঙ্গু আক্রান্ত ৬ জনের মৃত্যু

বরগুনা জেলায় ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। সরকারি হিসাবে চলতি বছর জেলায় ডেঙ্গু আক্রান্ত পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। তবে স্থানীয়ভাবে খোঁজ নিয়ে আরও ছয়জনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে, তাঁরা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ছিলেন বলে জানিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। সেই হিসাবে জেলায় চলতি মৌসুমে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় ১১।

সরকারি হিসাবের বাইরে যে ছয়জনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে, তাঁরা সবাই বরগুনাতেই ডেঙ্গু আক্রান্ত হন। এরপর ঢাকার সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় চারজনের মৃত্যু হয়। বাকি দুজনকে বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান। মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে শিশু থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সী মানুষ রয়েছে। মারা যাওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্যগুলো জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কেউ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে জেলার সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেলেই কেবল সরকারি তালিকায় তথ্য যুক্ত হয়। জেলার বাইরে কিংবা বাড়িতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা গেলে সেই তথ্য সরকারের খাতায় উঠছে না। স্থানীয় লোকজনের ধারণা, বরগুনায় ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা সরকারি-বেসরকারি হিসাবের চেয়েও বেশি।

জেলার বাইরে ৫ জনের মৃত্যু, বাড়িতে ১

বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বিভাগে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১৯ জুন পর্যন্ত ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে বরগুনার ৫ জন। তবে যেসব রোগী বিভাগের বাইরের হাসপাতালে মারা গেছেন, তা সরকারিভাবে নথিভুক্ত হয়নি।

সরকারি হিসাবের বাইরে অনুসন্ধান করে আরও ছয়জনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে। ২৯ এপ্রিল বরগুনা জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম মোল্লার ছোট মেয়ে উপমা (১৫) রাজধানীর কাকরাইলের ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর মেয়ে এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে ডেঙ্গু পজিটিভ হয়। পরে তার অবস্থা গুরুতর হলে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে ভর্তি করা হয়। সেখানে ২৯ এপ্রিল মারা যায়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের ডেঙ্গু পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা গেছে, কাকরাইলের ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতালে চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত কারও মৃত্যুর তথ্য নেই।

জায়গা না হওয়ায় বরগুনা জেনারেল হাসপতালের বারান্দায় চলছে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা

১২ জুন বরগুনা শহরের মুসলিম পাড়ার বাসিন্দা তোফাজ্জল হোসেনের স্ত্রী পাপড়ি বেগম (৫২) ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ঢাকার অপর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। আজ বৃহস্পতিবার সকালে পাপড়ি বেগমের বাসায় গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি, দরজা তালাবদ্ধ ছিল। প্রতিবেশীরা জানান, পাপড়ি বেগম ও তাঁর মেয়ে দুজনই বরগুনায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাঁর মেয়ে এখনো ঢাকায় চিকিৎসাধীন।

পাপড়ি বেগমের ভাইয়ের ছেলে শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমার ফুফুর ডেঙ্গু শনাক্ত হলে শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। পরে তাঁকে ঢাকায় নিয়ে গেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১২ জুন মারা যান। আমার ফুফাতো বোনও ডেঙ্গু আক্রান্ত।’

সদর উপজেলার বুড়িরচর ইউনিয়নের হাজারবিঘা গ্রামের নাইমুর রহমান ওরফে প্রিন্স (২৫) নামের অপর এক তরুণের মৃত্যু হয় ১৩ জুন। তিনি বরগুনা সরকারি কলেজের স্নাতক (সম্মান) শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তাঁর নানা নুরুল হক বলেন, ‘নাইমুরের জ্বর হওয়ার পর বরগুনায় পরীক্ষা করালে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। এরপর তার অবস্থার অবনতি হলে ঢাকায় কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নাইমুর মারা যায়। নাইমুর আমাদের বাসাতেই থাকত, লেখাপড়া করত।’

বরগুনা সদরের লাকুরতলা এলাকার সাফাওয়ান আবদুল্লাহ (৩) নামের আরেক শিশু ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার পর তাকেও উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেওয়া হয়। পরে রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকার পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৫ জুন মারা যায়। সাফাওয়ানের দাদা মতিউর রহমান জানান, নাতনির জ্বর হওয়ার পর পরীক্ষা করালে ডেঙ্গু ধরা পড়ে। এরপর বাসায় চিকিৎসা চলছিল। পরে অবস্থা খারাপ হলে ঢাকায় বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে অপর একটি বেসরকারি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে নেওয়ার পথে মারা যায়।

ডেঙ্গু আক্রান্ত সদর উপজেলার ফুলতলা গ্রামের জয়নাল আবেদিনকে (৪২) উন্নত চিকিৎসার জন্য ১৬ জুন বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপতালে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাঁচানো যায়নি। তাঁর মেয়ে মারিয়া আক্তার বলেন, ‘আমার বাবার জ্বর ছিল, পরে বরগুনায় পরীক্ষা করালে ডেঙ্গু ধরা পড়ে। এরপর বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে গেলে হাসপাতালের সামনে পৌঁছানো মাত্র তাঁর মৃত্যু হয়।’

বরগুনা সদরের হেউলিবুনিয়া গ্রামের বাদল মিয়া (৪৫) জ্বর নিয়ে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ১৩ জুন। তাঁর অবস্থার অবনতি হলে  ১৬ জুন তাঁকে বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হয়। কিন্তু স্বজনেরা সরাসরি তাঁকে বরিশাল না নিয়ে বাড়িতে নিয়ে যান। পরে ওই দিন রাতে তিনি বাড়িতে মারা যান।

বাদল মিয়ার ছেলে মো. রাসেলের শ্বশুর জামাল ভূঁইয়া গতকাল সকালে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা তাঁকে বরিশাল নেওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্স ঠিক করার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু এর মধ্যেই তিনি মারা যান।’

মৃত্যুর হিসাব নিয়ে গরমিলের বিষয়ে জানতে চাইলে বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা মূলত বিভাগের সরকারি হাসপাতালগুলোতে যেসব রোগী মারা যান, তাঁদের হিসাব সংরক্ষণ করি। বিভাগের বাইরে কিংবা বেসরকারি হাসপাতালে অথবা বাড়িতে কোনো রোগী মারা গেলে সেসব তথ্য আমাদের সংরক্ষণ করার সক্ষমতা কম। তারপরও আমরা তথ্য পেলে তা সংরক্ষণ করার চেষ্টা করব।’

ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালের শয্যা ও মেঝেতে চিকিৎসা চলছে। সম্প্রতি বরগুনা সদর হাসপাতালে

আক্রান্ত তিন হাজার ছাড়িয়েছে

এদিকে বরিশাল বিভাগে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা তিন হাজার ছাড়িয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১৯ জুন পর্যন্ত ৩ হাজার ২৯০ জন ডেঙ্গু রোগী সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে ২ হাজার ২৬ জনই বরগুনা জেলার। বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডল এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

সর্বশেষ বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত শেষ ২৪ ঘণ্টায় এই বিভাগে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সরকারি হাসপতালে ভর্তি হয়েছেন ১০৫ জন। এর মধ্যে ৭২ জন বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ নিয়ে বৃহস্পতিবার বরগুনার ২৫০ শয্যার হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন ২১৭ জন ডেঙ্গু রোগী।

আইইডিসিআরের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ

বরগুনায় ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানে কাজ করছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। সংস্থাটির ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল গত সোমবার বরগুনায় আসে। তারা গত বুধবার পর্যন্ত বরগুনা জেনারেল হাসপাতালসহ ডেঙ্গু আক্রান্ত এলাকাগুলো পরিদর্শন করে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছে।

প্রতিনিধিদলে রয়েছেন আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা রত্না দাস, এফইটিপিবি (ফিল্ড ইপিডিমিওলজি ট্রেনিং প্রোগ্রাম) ফেলো মো. তারিকুল ইসলাম ও মোস্তফা নাহিয়ান, কীটতত্ত্ববিদ মো. মোজাম্মেল হক, জ্যেষ্ঠ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট মো. আজিজুর রহমান এবং স্বাস্থ্য সহকারী মো. আবল্লাহ আল মামুন।

আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা রত্না দাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্ষাকালে জমে থাকা পরিষ্কার পানিই ডেঙ্গুর মূল উৎস হয়ে ওঠে। বরগুনায় কী কারণে আক্রান্তের সংখ্যা এত বেশি হচ্ছে, সেটা অনুসন্ধান করতেই আমরা এই এলাকা পরিদর্শনে এসেছি। আমরা হাসপাতালের পাশাপাশি এলাকার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে লার্ভা সংগ্রহ করেছি। একই সঙ্গে একটি জরিপ পরিচালনা করা হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, জেলা প্রশাসন, সিভিল সার্জন ও স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে তথ্য সংগ্রহ চলছে এবং অনুসন্ধান শেষে প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে সাত থেকে আট দিন সময় লাগবে।