‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় শনিবার (৮ নভেম্বর)। ছবি: প্রথম আলো
‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় শনিবার (৮ নভেম্বর)। ছবি: প্রথম আলো

অনলাইন আলোচনা

প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত হলে ফুসফুস ক্যানসার সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব

ফুসফুস ক্যানসার—শুনলেই ভয় লাগে। অথচ অনেক সময় এটি নীরবে শরীরের ভেতর বেড়ে ওঠে কোনো বড় উপসর্গ ছাড়াই। যখন রোগ ধরা পড়ে, তখন অনেকটাই দেরি হয়ে যায়। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত হলে ফুসফুস ক্যানসার সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব।

এসকেএফ অনকোলোজির আয়োজনে ‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনায় কথাগুলো বলেন ডা. তুষার দাস।

নভেম্বর মাস ‘ফুসফুস ক্যানসার সচেতনতার মাস’। ফুসফুস ক্যানসারবিষয়ক সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে আয়োজিত আলোচনার এ পর্বে অতিথি ছিলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ডা. তুষার দাস। উপস্থাপনায় ছিলেন নাসিহা তাহসিন।

এ পর্বে আলোচনার বিষয় ছিল ‘ফুসফুস ক্যানসার বার্তা’। বাংলাদেশে ফুসফুস ক্যানসার রোগের কারণ, ঝুঁকি, লক্ষণ, চিকিৎসা, সচেতনতা এবং প্রতিরোধব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে পরামর্শ দেন ডা. তুষার দাস। পর্বটি শনিবার (৮ নভেম্বর) সরাসরি প্রচারিত হয় প্রথম আলো ডটকম এবং প্রথম আলো, এসকেএফ অনকোলোজি ও এসকেএফের ফেসবুক পেজে।

ফুসফুস ক্যানসারের ধরন

ফুসফুস ক্যানসার মূলত দুই ধরনের বলে উল্লেখ করেন ডা. তুষার। এই দুই ধরন হলো—প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি। তিনি বলেন, প্রাইমারি ক্যানসার ফুসফুসের নিজস্ব কোষ থেকে উৎপন্ন হয় আর সেকেন্ডারি ক্যানসার শরীরের অন্য অংশ থেকে ছড়িয়ে ফুসফুসে আসে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এটি আবার দুভাগে ভাগ করা হয়—নন-স্মল সেল লাং ক্যানসার এবং স্মল সেল লাং ক্যানসার। প্রথম ধরনের রোগী বেশি দেখা যায়।

ফুসফুসের ক্যানসারের কারণ কী

ধূমপান না করলেও কি ফুসফুস ক্যানসার হতে পারে? উপস্থাপকের এমন প্রশ্নের উত্তরে ডা. তুষার দাস বলেন, অনেকের ধারণা, কেবল ধূমপায়ী হলেই ফুসফুস ক্যানসার হয়। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। ধূমপান অবশ্যই প্রধান কারণ, তবে বায়ুদূষণ, পরোক্ষ ধূমপান এবং জিনগত বিষয়ও বড় ভূমিকা রাখে। পরোক্ষ ধূমপান মানে হচ্ছে অন্যের ধোঁয়া নিজের অজান্তে শ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করা।

রান্নাঘরের কয়লা বা লাকড়ির ধোঁয়া থেকে ফুসফুস ক্যানসারের ঝুঁকি বিষয়ে উপস্থাপক জানতে চাইলে ডা. তুষার দাস বলেন, রান্নাঘরের কয়লা বা লাকড়ির ধোঁয়া ফুসফুসের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। বিশেষ করে যে নারীরা প্রতিদিন দীর্ঘ সময় ধরে এই ধোঁয়ার মধ্যে রান্না করেন, তাঁদের মধ্যে ফুসফুস ক্যানসারের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এই ধোঁয়ার মধ্যে এমন সব রাসায়নিক পদার্থ থাকে, যা ধীরে ধীরে ফুসফুসের কোষে ক্ষতি করে। শুধু ক্যানসার নয়, এই ধোঁয়ার কারণে শ্বাসকষ্ট, ব্রঙ্কাইটিস, দীর্ঘস্থায়ী কাশি বা ফুসফুসের সংক্রমণও হতে পারে।

তুষার দাস বলেন, ফুসফুস ক্যানসারের পেছনে কিছু জিন মিউটেশন ভূমিকা রাখে। তাই যেসব পরিবারের কারও এ রোগের ইতিহাস রয়েছে, তাদের সন্তানদের ক্ষেত্রে বয়স ৩০ পেরোলেই নিয়মিত স্ক্রিনিং শুরু করা উচিত। বাংলাদেশে বেশির ভাগ রোগী দেরিতে অর্থাৎ স্টেজ-৩ বা স্টেজ-৪ পর্যায়ে হাসপাতালে আসেন। এর মূল কারণ হলো অসচেতনতা, ভুল চিকিৎসা কিংবা উপসর্গকে সাধারণ ঠান্ডা-কাশি ভেবে অবহেলা করা।

কাশির সঙ্গে রক্ত এলে দ্রুত ডাক্তার দেখান

ডা. তুষার দাস বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার পরামর্শ হলো, যদি তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে কাশি থাকে, বিশেষ করে কাশির সঙ্গে রক্ত আসে, তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।’

সাধারণ কাশি আর ফুসফুস ক্যানসারের কাশির মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কে ডা. তুষার দাস বলেন, পার্থক্য খুব সূক্ষ্ম, সচেতন থাকলেই তা বোঝা সম্ভব। সাধারণ সর্দি-কাশি ভাইরাস ও অ্যালার্জিজনিত কারণে হয়ে থাকে এবং সাধারণত এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যেই সেরে যায়।

ডা. তুষার বলেন, যদি কাশি তিন সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হয়, বিশেষ করে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খাওয়ার পরও না কমে, কিংবা কাশির সঙ্গে রক্ত ওঠে বা শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, তাহলে তা আর হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয়। এ সময় একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা যেমন এক্স-রে বা লো-ডোজ সিটি স্ক্যান করানো উচিত। কারণ, ফুসফুস ক্যানসার প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়লে নিরাময়ের সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে।

বাংলাদেশে ফুসফুস ক্যানসার রোগের কারণ, ঝুঁকি, লক্ষণ, চিকিৎসা, সচেতনতা এবং প্রতিরোধব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে পরামর্শ দেন ডা. তুষার দাস

লক্ষণ কী

কাশি ছাড়া ফুসফুস ক্যানসারের আর কোনো লক্ষণ আছে কি না? জানতে চাইলে ডা. তুষার দাস বলেন, ফুসফুস ক্যানসারের সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণ হলো দীর্ঘস্থায়ী কাশি। তবে এটি ছাড়া আরও কিছু উপসর্গ দেখা দিতে পারে। কাশির পাশাপাশি বুকে ব্যথা, বিশেষ করে যে স্থানে ক্যানসার হয়েছে, সেখানে ব্যথা অনুভব হওয়া, খাওয়ায় অরুচি, ওজন কমে যাওয়া, বমি বমি ভাব এমনকি শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া ইত্যাদি।

চিকিৎসা

এরপর উপস্থাপক জানতে চান, ফুসফুস ক্যানসার প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা সম্ভব কি না? উত্তরে ডা. তুষার দাস বলেন, উন্নত দেশগুলোতে এখন স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম চালু আছে, যেখানে কোনো উপসর্গ না থাকলেও নিয়মিত পরীক্ষা করে ফুসফুসে কোনো অস্বাভাবিকতা আছে কি না, তা দেখা হয়। বিশেষ করে লো-ডোজ সিটি স্ক্যানের মাধ্যমে রোগটি প্রাথমিক পর্যায়, অর্থাৎ স্টেজ-ওয়ান বা টু-তে শনাক্ত করা যায়। এই পর্যায়ে ধরা পড়লে অপারেশনের মাধ্যমে রোগ সম্পূর্ণ নিরাময়ের সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে।

ডা. তুষার দাস বলেন, তবে দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশসহ অনেক দেশেই বেশির ভাগ রোগী দেরিতে চিকিৎসা নিতে আসেন, যখন ক্যানসার স্টেজ-থ্রি বা ফোরে পৌঁছে যায়। এতে করে পাঁচ বছরের মধ্যে মৃত্যুহার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যায়।

ফুসফুস ক্যানসারের চিকিৎসায় কেমোথেরাপির পাশাপাশি আধুনিক ও কার্যকর পদ্ধতি সম্পর্কে ডা. তুষার দাস বলেন, বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত পদ্ধতি হলো ইমিউনোথেরাপি, যেখানে শরীরের নিজস্ব রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে ক্যানসার কোষ ধ্বংস করা হয়। এটি কেমোথেরাপির তুলনায় কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তবে চিকিৎসাটি ব্যয়বহুল হলেও এখন বাংলাদেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে তুলনামূলক কম খরচে এটি পাওয়া যাচ্ছে। একইভাবে টার্গেটেড থেরাপি এখন ফুসফুস ক্যানসার চিকিৎসার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ প্রযুক্তি ও জিনভিত্তিক চিকিৎসা এখন ফুসফুস ক্যানসারর মোকাবিলায় নতুন আশার আলো হয়ে উঠেছে।’

ফুসফুস ক্যানসার সম্পূর্ণ নিরাময় করা সম্ভব কি না? এমন প্রশ্নের উত্তরে ডা. তুষার দাস বলেন, ‘স্টেজ-ওয়ান বা টু-র মধ্যে শনাক্ত হলে অস্ত্রোপচার, কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপির মাধ্যমে রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হতে পারেন। তবে অধিকাংশ রোগী দেরিতে চিকিৎসা নিতে আসায় তখন রোগটি জটিল আকার ধারণ করে। চিকিৎসা শেষে প্রথম বছর ছয় সপ্তাহ পরপর এবং পরবর্তী বছরগুলোতে নির্দিষ্ট সময় পরপর ফলোআপ জরুরি।’

আলোচনার শেষ পর্যায়ে ফুসফুস ক্যানসার থেকে সুরক্ষার বিষয়ে ডা. তুষার দাস বলেন, ৪০ বছরের কম বয়সীদের জন্য সুস্থ জীবনযাপনই সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষা। নিয়মিত ব্যায়াম, ফলমূলভিত্তিক সুষম খাদ্য গ্রহণ, ওজন নিয়ন্ত্রণ, ধূমপান ও ই-সিগারেট পরিহার—এই অভ্যাসগুলো ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। ই-সিগারেটেও নিকোটিন ও ক্ষতিকর রাসায়নিক থাকে; তাই এটিও ক্যানসারের ঝুঁকি থেকে মুক্ত নয়।

ফাস্ট ফুড, তেল-চর্বি ও অতিরিক্ত মসলাযুক্ত খাবার পরিহার এবং দেশীয় ফলমূল খাওয়ার পরামর্শ দেন ডা. তুষার।