
‘আকন্দ বনের দিকে;—একদল দাঁড়কাক ম্লান গুঞ্জরণে
নাটার মতন রাঙা মেঘ নিঙড়ায়ে নিয়ে সন্ধ্যার আকাশ’
—জীবনানন্দ দাশ
গ্রামবাংলায় উঠানে সেদ্ধ ধান শুকাতে দিলে চড়ুই, দাঁড়কাক, কবুতর, গৃহপালিত হাঁস ও মুরগি ছুটে আসে। ছেলেবেলায় উঠানের এক পাশে গাছের ছায়ায় লম্বা লগি নিয়ে বসে থাকতে হতো পাখি তাড়ানোর জন্য। গৃহপালিত হাঁস-মুরগি তাড়িয়ে দিলেও দাঁড়কাক ও চড়ুই কখনো তাড়িয়ে দিতাম না। ওগুলোর ধান খাওয়ার দৃশ্য দেখতে ভালো লাগত। চড়ুই কিচিরমিচির ডাক ও জোড়া পায়ে লাফ দিয়ে উঠান জমিয়ে রাখত। দাঁড়কাক আসত প্রায় সময় এক জোড়া।
একটি গ্রামে সাধারণত কয়েক জোড়া দাঁড়কাক বাস করত। প্রতিটি জোড়ার বিচরণ এলাকা ভাগ করা থাকত। মাঝেমধে৵ কোনো খাবারের উৎস পেলে দাঁড়কাকের ছোট দলটি দেখা যেত। দাঁড়কাক যে খুব বেশি সেদ্ধ ধান খেত, তা কিন্তু নয়। ঠোঁট এগিয়ে কয়েকবার নিত, তারপর চলে যেত। কোনো বাড়িতে ধান সেদ্ধ করলেই দাঁড়কাক নতুন ধানের ঘ্রাণে উড়ে আসত উঠানে। এ ছাড়া ঠোঁটে করে হাঁস–মুরগির ছানাগুলো নিতে আসত। দাঁড়কাকের ঠোঁট থেকে হাঁসের ছানা উদ্ধারের অভিযান একসময় গ্রামবাংলায় দেখা যেত।
শহরে বাজারের কাছে মাঝারি ও বড় বড় ঝাঁকে পাতিকাক দেখা যায়। তবে দাঁড়কাকের ঝাঁক খুব কমই চোখে পড়ে। বড়জোর দু–চারটি দেখা যায়। সুন্দরবনের কটকা, কচিখালীসহ বন বিভাগের ফাঁড়িতে গিয়ে এক জোড়া করে দাঁড়কাক দেখেছি। ঢাকা শহরের রমনা পার্কে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক পাতিকাক দেখা যায়। দাঁড়কাক দেখা যায় দুই বা তিন জোড়া।
২০০৯ সালে বরগুনা জেলায় গিয়ে একবার একদল দাঁড়কাকের দেখা পাই। একটি বাড়ির কাছের মেঘশিরীষ গাছে বসে তারা সভা করছিল। এতগুলো দাঁড়কাক দেখে সেদিন রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতার কথা মনে পড়ে যায়। কবি কোনো এক আকন্দ বনে একদল দাঁড়কাক দেখেছিলেন গুঞ্জনরত।
সারা বিশ্বে কাকের প্রায় অর্ধশত প্রজাতি-উপপ্রজাতি রয়েছে। বাংলাদেশে মাত্র দুটি প্রজাতির বসবাস। ইউরোপে শহরের কাকের আচরণ নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। সেই অর্থে বাংলাদেশে একক প্রজাতিভিত্তিক গবেষণা হয়নি। এ রকম গবেষণার জন্য যে ধরনের গবেষণাগার দরকার, দেশে সেটি নেই। এখনো আমাদের দেশি প্রজাতিগুলো শনাক্ত করতে উন্নত বিশ্বের গবেষণার তথ্য ব্যবহার করতে হয়।
দাঁড়কাক খুবই বুদ্ধিমান পাখি। নগর ও গ্রাম পরিষ্কার রাখতে দাঁড়কাকের অবদান রয়েছে। দাঁড়কাক সচরাচর জোড়ায় চলে। কদাচিৎ একা ও ছোট দলে দেখা যায়। পাতিকাকের সঙ্গে দাঁড়কাকের দ্বন্দ্ব চোখে পড়েনি। পাতিকাকের চেয়ে আকারে বড় হলেও জাতভাইদের সঙ্গে দাঁড়কাক ঝগড়াঝাঁটি করে না। এ কারণে পাতিকাক দাঁড়কাককে সমীহ করে চলে। শহরে তারা মিলেমিশেই থাকে, খাবার খায়।
দাঁড়কাক বাংলাদেশসহ ভারত উপমহাদেশের অন্যান্য দেশে বসবাস করে। প্রাকৃতিক বিবর্তনে দাঁড়কাকের কয়েকটি উপপ্রজাতি সৃষ্টি হয়েছে। গভীরভাবে ঠোঁটের আকার ও পালকের বর্ণ পর্যবেক্ষণ করলে উপপ্রজাতি চেনা যায়। দাঁড়কাক পরিবেশের জন্য খুবই উপকারী। পালকের বর্ণ কালো এবং কর্কশ ডাকের কারণে দাঁড়কাককে অবজ্ঞা করা ঠিক নয়। সুন্দর এই পাখি আমরা যেন ভালোবাসতে পারি।