‘জাভা’ মাছের পেটের মধ্যে মূল্যবান ফুসফুস। পাঙাশের কদর একটু কম হলেও ভাঙান, কাইন, পারশের কদর আছে বেশ।
জোয়ার-ভাটা, স্বাদু-নোনাপানির সঙ্গে সমুদ্রসংলগ্ন নদী হওয়ায় দেশের সবচেয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ মাছ পাওয়া যায় সাতক্ষীরা এবং এর আশপাশের এলাকায়। এসব মাছের অধিকাংশ রাজধানীর বাজার পর্যন্ত আসে না। সেখানকার স্থানীয় ও আশপাশের জেলা-উপজেলার হাটবাজারে বিক্রি হয় এই মাছ।
হাটবাজার মানেই হুলুস্থুল ব্যাপার। হাটসংশ্লিষ্ট খেয়াঘাটের চরিত্রটা আবার একটু আপন আপন। তাড়া থাকলেও মানুষ দুদণ্ড দাঁড়িয়ে কথা বলে। চা-পান খায়। শ্যামনগরের প্রণব মণ্ডল ওই করতে গিয়ে ধরাটা খেলেন। ভালোই যাচ্ছিলেন লম্বা-চওড়া হাসিমুখে। নীলডুমুরের নওয়াবেঁকী ঘাটে উঠতেই কয়েকজন মাছের দাম জানতে চাইল। ভীষণ খুশি মানুষটা একটু থেমে গর্বের সঙ্গে জানালেন, হাজার টাকায় নিয়েছেন শ্বশুরবাড়ির জন্য। প্রাগৈতিহাসিক কালের পাথুরে রঙের শরীর আর পৃথক অঙ্গের মতো বসিয়ে রাখা কুদেমার্কা চোখের খুদে তিমির এমন সংস্করণ আগে দেখিনি। সরল মনে মাছের নাম জানতে চাইলাম। ওটা ‘চরখাদা’ শুনেই নদীর খাদ থেকে লাফিয়ে উঠলেন একজন। বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করে বললেন, ‘এহ্, নাম জানে না, দ্বিগুণ দামে মাছ কিনে কত খুশি। এর নাম “মোচড়”।’ প্রণব মণ্ডলের হাসিটাই দুমড়েমুচড়ে গেল এবার।
সুন্দরবনের উপকূলঘেঁষা জনপদের মাছেরা স্বভাবে ও বিচরণে দেশের অন্য সব এলাকার মাছেদের সঙ্গে কৌলীন্য প্রথা বজায় রেখে চলেছে সব সময়ই। তবে স্থানীয় মানুষের মাছের নাম না জানা হলো মাঝির সেই সাঁতার না জানা গল্পের মতো। প্রণব মণ্ডল তাঁর শোক কবে ভুলবেন জানি না, আমি উৎসুক হলাম এমন আরও কিছু মাছের সঙ্গে পরিচিত হতে। বৃক্ষের পরিচয় ফলে হলে নদীর পরিচয় মাছে হওয়া উচিত। সুন্দরবন মানেই আঠারো ভাটির বারো রকম। বাদাবনের মাছ দেখতে হলে যাওয়া উচিত ছোট জাল দিয়ে শুধু পরিবারের জন্য মাছ ধরা মানুষদের কাছে। নদীর কিনারে ফেলা তাদের ছোটখাটো ঝাঁকি বা ঠেলাজালে বড় মাছের কমতি হলেও বৈচিত্র্যে ভরন্ত। শ্যামনগরের নীলডুমুর হয়ে গাবুরার শেষ মাথায় চাঁদনীমুখা একেবারে বাদাবনের প্রতিবেশী গ্রাম। গনগনে দুপুরে উপস্থিত হলেই এ অঞ্চলের ‘গনগনে’ মাছের সঙ্গে দেখা হওয়ার নিশ্চয়তা দেওয়া যাচ্ছে না, তবে যাদের দেখা পাবেন, তাদের ঠিকুজি মুখস্থ কঠিন। এখানে খোলপেটুয়া পেটমোটা। মাঝেমধ্যেই সে তেড়ে আসে লোকালয়ে। দক্ষিণে সামান্য আগালেই রেসের গতিতে বঙ্গোপসাগরের দিকে দৌড়াচ্ছে আড়পাঙাশিয়া। পাঙাশের কদর একটু কম হলেও সমগোত্রীয় মাসতুতো-পিসতুতো মীন ভাইবোন ভাঙান, কাইন, পারশের আদর আছে। যদিও ভাঙান মাছের সঙ্গে রুইয়ের স্বাদের ব্যবধান পাওয়া কঠিন। কপোতাক্ষ, খোলপেটুয়া, আড়পাঙাশিয়ার মতো দাপুটে নদ-নদীর পানি সময়ভেদে নোনা-স্বাদু—দুই স্বাদ হওয়ায় বাস্তুতন্ত্রের প্রভাবে বৈচিত্র্য পেয়েছে কুলীন মাছেরা।
চন্দ্রমুখার কাছে তখন সদ্যই জাল টেনে উঠেছেন কয়েকজন। একই জালে নানা রকম মীনশাবক আসায় জড়ো হলো একদঙ্গল ছেলেমেয়ে। রুপচাঁদার ধরন কিন্তু গায়ের রংটা শ্যামলা মেয়ের মতো একটা চ্যাপ্টা মাছের। চাপা রং বলেই কি না নিজেকে সুন্দর করার প্রচেষ্টায় শরীরে নানা বর্ণের নকশা তৈরি করেছে ‘পায়রা’। তার নামে পাখি আর বন্দর দুই-ই আছে। পাওয়াও যায় দুরকম চাঁদা আর অলি পায়রা। এর পাশেই রাখা রঙিন তেলাপিয়া, কথ্য সম্বোধনে ফাইশ্যা হচ্ছে ফেসা, আছে খয়রা, পারশে। ধবধবে একটা মাছ কাদায় গড়াগড়ি দিয়েছে ধরে আনার শেষ সময়। শৈশবকালে মাছ ও মানুষ দুটোরই কাদা মাখার অবাধ স্বাধীনতা থাকে। এ মাছের নাম শুনে আমার চোখও জ্বলজ্বল করে উঠল। সুন্দরবনের সবচেয়ে দামি মাছগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘জাভা’। বড় হলে এর কেজি ১০ হাজার টাকায়ও বিক্রি হয়। তবে জাভার রূপ-গুণের গোপন রহস্য থাকে গোপনে। পেটের মধ্যে মূল্যবান ফুসফুস, যেটা থেকে তৈরি হয় আরও মূল্যবান ওষুধ। বাতাসযন্ত্রটা বের করে নিলে এর সঙ্গে নছি মাছের বিশেষ পার্থক্য নেই দামে। আফসোস যে জাভার পরিণত খোলতাই চেহারাটা দেখা হলো না। কী আর করা যাবে, এখন তো আর হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সেই হাজার বছর আগেকার রুপা রাজার নির্দেশ মেনে একমণি কম ওজনের মাছ ধরা হয় না (বেণে মেয়ে উপন্যাস)।
ভাগ্য ভালো, এই শিশু মাছদের সঙ্গে দেখা হলো। স্থানীয় মানুষ ধরে না আনলে বাজারে এ বয়সের মৎস্যপুত্র-কন্যাদের দেখা মেলে না। বাজার বলতেই বিপণনটা দেখতে ইচ্ছা হলো।
সাতক্ষীরার বিনেরপোতা মাছের আড়তটা সদর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে। সেখানে দেখবেন, আড়তের নোনাপানি থেকে পা বাঁচাতে গামবুট পায়ে হাঁটাহাঁটি করছে। সকাল আটটার দিক থেকে ট্রাক আসা শুরু হলে রীতিমতো মচ্ছব। এ বাজারে ঘোরাফেরা করলে সমুদ্র থেকে ঘের, নদী থেকে পুকুরে চাষ করা সব মাছের সঙ্গে দেখা হবে। বড় সমস্যা হচ্ছে, মাছের নাম জানা। এক দোকানে শুনলেন ‘ভাঙান’ তো পাশের দোকানে বলবে ‘সেলুর ভাঙন’। ভোলা মাছের নাম শুনে খুশি হয়ে আগাতে আগাতেই দেখি আরেক দোকানে ডাকছে ‘পোয়া’ নামে। এখানে মুফতে পাওয়া যাবে বড় চিংড়ির বিচ্ছিন্ন মাথাও। এসব বিক্রি হবে আলাদাভাবে। কেজিপ্রতি মাত্র ৭০ টাকা। অথচ মাথার আকার দেখেই বোঝা যাচ্ছে, আসল মাছ কেজিপ্রতি কমসে কম হাজার টাকার কমে বললে বিক্রেতা রাগ হতে পারেন। এ বাজার বিচিত্র। এখানে মাছ পাল্লা হিসেবে নিলামে তোলা হয়। আধা কেজি, এক কেজির সুযোগ নেই। অধিকাংশ ক্রেতা আসেন নিজের দোকানের জন্য মাছ নিতে। তবে এর মধ্যেই গোপনে একজন নিয়ে বসেছেন কিছু খুদে কাঁকড়া।
কাঁকড়ার প্রসঙ্গ আসায় দুটো কথা না বললেই নয়। পানির ভারসাম্য রক্ষায় খুবই দায়িত্বশীল সে। ঝরে যাওয়া পাতা নিজ দায়িত্বে কুচি কুচি করে কেটে মাছেদের খাবার তৈরি করে প্রাকৃতিক রন্ধনশিল্পীর খেতাব পেয়েছে কাঁকড়া। অবশ্য সন্ন্যাসী কাঁকড়া আবার ভয় পেলেই শামুকখোলে আশ্রয় নেয়। রপ্তানিযোগ্য কাঁকড়ার পুলসিরাত অতিক্রম কায়ক্লেশের। নারী কাঁকড়া ১০০ গ্রাম আর পুরুষ কাঁকড়া ১৫০ গ্রামের কম ধরা নিষেধ। রপ্তানিযোগ্য কাঁকড়ার মূল্য নির্ধারণ হয় ওজনে। যদিও কাঁকড়াদের অঙ্ক করার অদূর ভবিষ্যতেও সম্ভাবনা নেই, তবে তাদের মগজের পরিমাণ পরীক্ষা হয় রীতিমতো টর্চ জ্বালিয়ে। কাঁকড়া যে চিংড়িকে এক দৌড়ে পেছনে ফেলে দিয়ে সামনে এগিয়েছে, তা নিয়ে আর নতুন কিছু বলার নেই। তবে খামারে ওদের বড় হওয়ার ধরনটা একটু সঙিন। তাদের নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত খেলার সঙ্গী ছাড়া একা একাই বড় হতে হয়। এ অঞ্চলের নদী আর বননির্ভর মানুষের হিসাবটা ভিন্ন। তাঁরা ভাটিগা আর গোণের কালের হিসাব করে। সে হিসেবে গোণের কাল এলে কাঁকড়ারা ডাঙার দিকে উঠে আসতে চায়।
পরিণত জাভা না দেখে এ অঞ্চল থেকে ফিরে যাওয়া অনুচিত। তাকে খুঁজতে রওনা হলাম খুলনায়। সকাল সকাল গেলে নিউমার্কেটের বাজারে পাবেন মাছ বরণের আয়োজন। ককশিটের বাক্সে বরফ রেখে ডালায় কলাপাতা বিছিয়ে বসে আছেন বিক্রেতারা। কলাপাতায় কাঁচা মাছ ঠান্ডা থাকে। কিছুক্ষণ পরই এ অঞ্চলের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মাছ আসবে ঘাট হয়ে বাজারে। সে অপেক্ষা করতে করতে দেখা হলো সেই কুলীন জাভার সঙ্গে। বিক্রেতা মাছের পেট থেকে বাতাসযন্ত্র বের করে দেখালেন। এই সেই মহার্ঘ, যার জন্য দামের ও রকম তফাত। পরিণত জাভা খুলনার বাজারে শুয়ে আছে মৎস্যকন্যার মতো আয়েশে। পাশেই পাওয়া গেল হলুদ কেশরের ভোলা মাছকে। দেখতে ছোটখাটো হলেও ভোলা নামে জেলা, এ নামে নদী থাকায় তারও দেমাক কম নয়। মুখ ঘুরিয়েই রইল সে।
মাছ খুঁজতে হলে বাজার একটা বড় ব্যাপার। কোন দোকানের চাল খাচ্ছেনের মতো অবস্থা। এখানকার সন্ধ্যা বাজার অসূর্যম্পশ্যা। পথের পাশ দিয়ে বাতি জ্বালিয়ে ডালা নিয়ে যেন লাইন টেনে বসেছেন বিক্রেতারা। একগাল হেসে পরিচয় করিয়ে দিলেন একজন ‘তাইড়্যাল’ শুদ্ধ ভাষায় তাড়িয়ালের সঙ্গে। প্রায় ‘ভোলা’ মাছের কাছাকাছি রূপ। গুণ কেমন জানি না, তবে একে বেশি ঝাঁজে রাঁধতে নেই। মাছবাজারে ঘুরলে আপনার দশাও সাতক্ষীরার প্রণব মণ্ডলের মতো হতে পারে। এ বলল পারশে তো কিছু দূর গিয়েই শুনবেন সেটার আরেক নাম। এখানে বলল ভাঙন তো ওখানে বলবে এটা ‘আধা ভাঙন’।
তাড়িয়াল দেখে তাড়া নিয়ে ফেরার পথে সেই কুলীন হয়েও সর্বজনে মিশে যাওয়া ‘সাদা সোনা’র থালা চোখের সামনে। বাগদা, গলদা, চাকা আর হরিণা চিংড়ি। এমনি তো আর অস্থির মানুষকে চিংড়ির মতো ছটফট করছে বলা হয় না। না হলে বোকার মতো নোনাপানি সয়ে নিয়ে কৃষকের ক্ষতি হতে দেয়? এখন নিজের দৌড়েই কাঁকড়ার কাছে রানার্সআপ। এখান থেকে বের হয়ে এলাম দ্রুত। সাতসকালে দাকোপে অভিযান আছে। এ অঞ্চলে একটু দূরেই যাওয়া মানে খেয়াঘাটের সঙ্গে দেখা। আর ঘাট মানেই নতুন নতুন মাছ আর ভিন্ন মুখে এক মাছের অনেক রকম নাম।
কে জানত দাকোপের কালাবগি যাওয়ার পথে তারই সঙ্গে দেখা হবে, যে আছে অপেক্ষা করে গায়ে রং নিয়ে। তাঁর সমস্ত শরীরে আলোর দ্যুতি। সে এ অঞ্চলের খুদে ক্ষেত্রাধিপতি। ভদ্রা নদীর খেয়াঘাটে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে প্রায় পায়ের কাছ দিয়ে লাফিয়ে গেল নীল আলোর ছটা। সে কাদা ও পানি উভয়েই সমান চটপটে। ক্যামেরা তাক করার আগেই এক ফুটের লাফ। গাল ফোলানো সে ‘মেনি’। ওকেই আবার কেউ কেউ ডাকে মেনু বা মিনু নামে। অনেকেই চেনে ইংরেজি ‘মাডস্কিপার’ হিসেবে। মেঘলা দিন না হলে আরও বেশি জেল্লাই দেখাত রঙের। তাঁর এই বিচিত্র রং সুন্দরবনের বৈচিত্র্যময় বাস্তুসংস্থানের প্রতীক। স্কুলের ব্যাক বেঞ্চের শিশুর মতোই বুদ্ধিতেও সেরা। ফোলা মুখে পানি ছিটিয়ে ঝুঁকে থাকা পাতায় বসা পোকাকে সশস্ত্র হামলা চালিয়ে ঘায়েল করে মেনি।
বাদাবনে নদীর খাঁড়ি থেকে সরু গোপন নালা, শ্বাসমূলের ফাঁকে ফাঁকে লুকোনোর আস্তানা, জোয়ারে উঠে ভাটায় নেমে যাওয়ার অভিজ্ঞতা সেই সঙ্গে স্বাদু-নোনাপানির সঙ্গে সহাবস্থানে সুন্দরবনের মিনেরা বাংলাদেশের উচ্চবংশীয়। রহস্যময় সুন্দরবনের অলিগলির সন্ধান জানে ওরা। চোখেমুখে সে গর্ব স্পষ্ট এই লোকালয়ের মাছেদের। বিশ্বাস না হলে নিজেই একবার ঘুরে দেখতে পারেন। সুন্দরবন ভালোবাসা মানুষ যদি বাদাবনের নদী, মাছ না চেনে, তাহলে আকবর বাদশার সঙ্গে হরিপদ কেরানির কোনো ভেদ থাকে না। ভালো কথা, আকবর বাদশা কিন্তু সত্যি সত্যি মাছ খেতে ভালোবাসতেন। আইন-ই-আকবরি আর ইম্পিরিয়াল গেজেটে উল্লেখ আছে, প্রাচীন ভারতবর্ষের ১৩টি মহাবন ছিল। এরই একটি আঙ্গেরীয়। মতান্তরে সে আঙ্গেরীয়রই অংশ আজকের সুন্দরবনের অরণ্য। মাছে-ভাতে বাঙালির পাতে নাম না জানা মাছের টুকরো উঠে এলে নিজের সম্মান থাকে?