
চা-স্বর্গ শ্রীমঙ্গল থেকে মৌলভীবাজারের পথে চা-বাগানের অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে দেখতে পথ চলছি। শীতের হিমেল সকালে ফিনফিনে কুয়াশার ওড়না জড়িয়ে গুটিসুটি মেরে বসে আছে চা-গাছেরা। বর্ষার পর পাতারা যে রকম সবুজ ছিল, এখন মাঘের শীতে কিছুটা কাবু হয়ে পড়েছে। যেতে যেতে কিছুক্ষণ পর কুয়াশা ছিঁড়ে সূর্য উঁকি দিল। রোদের ঝলকে ফালি ফালি আলোর টুকরো যেন হঠাৎ আছড়ে পড়ল চা-বাগানের ঢালগুলোতে। কোথাও ছায়া, কোথাও আলো—এ যেন কবি বুদ্ধদেব বসুর কবিতার সেই দ্রৌপদীর শাড়ি।
চা-বাগানের ছায়াতরুগুলো এলোমেলোভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে তখনো নিশ্চুপ ভিজছে কুয়াশা আর শিশিরে। গাছগুলোর নিচে থরে থরে সাজানো ঠাসাঠাসি অনুচ্চ চা-গাছ। এসব দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম মৌলভীবাজার সার্কিট হাউসে। শত বছরের ওপরে সার্কিট হাউসের বয়স। তারই প্রাঙ্গণে মৌলভীবাজারের প্রকৃতিকে বোঝানোর জন্য এক ফালি চা-বাগান করা হয়েছে, কিনারায় আগরগাছের সারি। ছোট্ট সে বাগানটার ভেতরই লুকিয়ে ছিল চা-ফুলের বিস্ময়।
একটা মিষ্টি সুগন্ধের টানেই ওই চা-বাগানে ছুটে গেলাম। গাছের ডালে ডালে থোকা ধরে ফুটে আছে অনেক ফুল। ফুলের হালকা মিষ্টি সৌরভে মাতোয়ারা বাগানের বাতাস। খুদে মৌমাছি আর ছোট প্রজাপতিরা উড়ে বেড়াচ্ছে ফুল থেকে ফুলে। গাছগুলোকে ছাঁটা বা পাতা তোলা হয় না বলেই হয়তো এভাবে বেড়ে উঠেছে। সে জন্যই এসব গাছে ফুলের এমন সম্ভার। সাধারণ চা-বাগানের গাছগুলো থেকে দু-এক সপ্তাহ পরপর পাতা তোলা হয় কুঁড়িসমেত। সে জন্য সেসব বাগানে ফুল ফোটার সুযোগ থাকে না।
চা-ফুল দেখতে অবিকল ক্যামেলিয়া ফুলের মতো, দুধসাদা রঙের পাপড়ি মেলে ফুটে আছে। ফুলে পাঁচ-সাতটা পাপড়ি, ফুলের পাপড়ির বিস্তার প্রায় তিন থেকে চার সেন্টিমিটার। ডালের গা ঘেঁষে তিন-চারটা ফুল থোকা ধরে ফুটে আছে। ফুলের মধ্যখানে হলদে রঙের পরাগকেশর আর গর্ভমূল রচনা করেছে স্বর্ণঝুমকার পটচিত্র। সেখানে খেলা করছে খুদে মৌমাছির দল।
চা-গাছের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Camellia sinensis। চিরসবুজ এ গাছ জন্মে পাহাড় বা টিলার ঢালে। চা-পাতা তুলে তুলে গাছগুলোকে খাটো করে রাখা হয়। পাতা না তুললে এসব গাছ প্রায় ৩০ ফুট লম্বা বৃক্ষ হতে পারত। সাধারণত চা-গাছে ফুল ফোটা শুরু হয় হেমন্ত থেকে, অক্টোবরের পরে। ফুল ফুটতে থাকে শীতকালজুড়ে। চা-গাছ বাঁচে ৩০ থেকে ৫০ বছর। ফুল ফোটা শুরু হয় বছর সাতেক বয়স থেকে। ফুল উভলিঙ্গী, মৌমাছিরা পরাগায়ন ঘটিয়ে ফল তৈরি করে। চা-গাছের ফল, সে আরেক অদ্ভুত জিনিস। ফল পাকতে অনেক সময় লাগে। ফল থেকে চারা হয়, আবার ফল ভাঙিয়ে তেল বের করা যায়। তেল সুগন্ধযুক্ত ও সুমিষ্ট। এ তেল দিয়ে রান্না করলে আলাদা স্বাদ আসে।
রবীন্দ্রনাথ খেয়াল করলে হয়তো ক্যামেলিয়া ফুলের মতো চা-ফুল নিয়েও একটা কবিতা লিখতেন। কেননা, ক্যামেলিয়া আর চা-ফুল আত্মজা, দুই সহোদরা। একই পরিবারের দুটি কন্যা। পরিবারের নাম থিয়েসি। দুটি ফুলের চেহারা আর মিষ্টি সৌরভ প্রায় একই রকম। একটির নিবাস হিমশৈলমালা হিমালয়ের পাদদেশে, অন্যটি অনুচ্চ গিরিমালার গৈরিক মাটিতে। ক্যামেলিয়া সারা পৃথিবীতে ফুলের সম্মান পেলেও চা-ফুল সে সম্মান পেল না। চা-গাছ আদরণীয় হয়ে উঠল তার সবুজ কচি পাতার দৌলতে, মানুষের দরবারে পানীয় পাত্রের আধারে।
রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে চা-ফুল নিয়ে হয়তো কোনো কবিতা পেলাম না। কিন্তু চা-ফুল দেখার উত্তেজনায় তাঁর আর একটি কবিতার লাইন অাওড়াতে আওড়াতে ফিরে এলাম সার্কিট হাউসে, মনে হলো ‘অনেককালের একটি মাত্র দিন, কেমন করে বাঁধা পড়েছিল, একটা কোনো ছন্দে, কোনো গানে, কোনো ছবিতে।’