পাখি

ভাতশালিকের কোকিলছানা

সেই কোকিলছানাটি l ছবি: সংগৃহীত
সেই কোকিলছানাটি l ছবি: সংগৃহীত

নানাবাড়ির নারকেলগাছে ভাতশালিকের বাসা। সেই বাসায় ছানা ফুটেছে। শালিক মা-বাবা মহাব্যস্ত ছানাদের খাবার খাওয়াতে। সাত বছর বয়সী মার্জান নানাবাড়িতে বেড়াতে এল একদিন। শালিকের ছানা হয়েছে শুনে জোর বায়না ধরল—পুষবে শালিকছানা খাঁচায় পুরে।
নাতির আবদার বলে কথা! অতএব, নানা-নানি একটি ছেলেকে গাছে চড়ালেন। শালিকদের প্রচণ্ড গালাগাল হজম করে সে খালুইতে করে দুটি ছানা নিয়ে নেমে এল গাছতলায়। ওমা! শালিকছানা কোথায়? এ দেখি কোকিলছানা! আজব-তাজ্জব ব্যাপার। কোকিলেরা চুরি করে সুকৌশলে ডিম পাড়ে কাকের বাসায়—এটাই তো জানে প্রায় সবাই। কিন্তু শালিকের বাসায়! তা-ও আবার কোটরের ভেতর!
ঘটনাটি গত মে মাসের ২৪ তারিখের। বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার রঘুনাথপুর গ্রামের। ওটাই আমার শ্বশুরবাড়ি।
মোবাইলে কল এল আমার কাছে। ওই নানা হচ্ছেন আমার বড় শ্যালক শহীদ। আমার প্রায় সমবয়সী। বিস্তারিত জানালাম তাঁকে। ছবি তোলার কথাও বললাম। ছানা দুটিকে আবার বাসায় তুলে রাখতে বললাম। উনি বললেন, দু-চার দিনের মধ্যেই সম্ভবত উড়তে পারবে এরা।
দুই দিন পরে বনী আমিন নামের বাগেরহাট শহরের এক তরুণ তার মোবাইলে ছবি তুলতে গেল। ওই দিনই সকালে মেয়ে ছানাটি বাসা থেকে উড়াল দিয়ে এসে রান্নাঘরের পাশের সফেদাগাছটির ডালে বসেছিল। শ্যালকবধূ অবাক চোখে দেখলেন সফেদার ডালের ছানাটিকে, কী কৌশলে খাওয়াচ্ছে শালিক দম্পতি! আর ছানাটি গাল হঁা করে দুই ডানা মেলে ঝাঁকুনি তুলছে অবিরাম। দুপুরের আগে নারকেলগাছে চড়ে বাকি ছানাটিকে নামিয়ে আনা হলো (২৭ তারিখ)। ওটি পুরুষ। ছবি তুলল বনী। ই-মেইলে ঢাকায় পাঠাল আমার কাছে। ছানাটিকে আবারও তুলে রাখা হলো বাসায়। শালিক দম্পতি চিৎকার-শোরগোলে বাড়িটাকে যেন মাথায় তুলে ফেলল।
এ রকম আরেক জোড়া কোকিলের ছানা পাওয়া যায় এ বছরই ফকিরহাটের বিলকেন্দুয়ার নোনাডাঙা গ্রামের একটা মরা তালগাছের খোঁড়লে। শালিকের বাচ্চাদের পেড়ে নিয়ে যায় দুষ্টু ছেলেপুলেরা। রয়ে যায় কোকিলছানা দুটি।
কালো কোকিলেরা (Asian koel) ডিম পাড়ে কাকের বাসায়—এটা এ দেশের বহু মানুষ জানে, শুনেছে, বইতে পড়েছে, কেউ কেউ দেখেছেও। কিন্তু এই কোকিলেরা যে ভাতশালিক (Common Myna), কসাই বা মইনেকাজল পাখি (Long-tailed shrike), কুকো (Greater coucal), হলদেবউ (Black-hooded oriole), ছাতারে (jungle Babbler), মেঠো ছাতারে, হাঁড়িচাঁচাসহ (Rutos treepie) আরও কিছু পাখির বাসায় ডিম পাড়ে, সেটা বহুজনেই জানে না।
কোকিলেরা যোগ-বিয়োগের অঙ্ক বা হিসাবটা খুবই ভালো জানে। গুনতেও পারে। সময়জ্ঞানও ঈর্ষণীয়। অন্য পাখির ডিম দেখেই বুঝতে পারে—ডিমের বয়স কত দিন, কত দিন পরে ফুটবে সেই ডিমের ছানারা, ওই বাসায় চুরি করে ডিম পাড়লে নিজের ডিম থেকে মূল ডিমগুলোর আগেই ছানা ফুটবে কি না—ইত্যকার নানা হিসাব কষেই অন্যের বাসায় ডিম পাড়ে কোকিলেরা। বংশগতির ধারায় কোকিলছানারা ডিম থেকে বেরোনোর দু-এক দিনের মধ্যেই বাসার আসল মালিকের ডিম বা ছানাদের ঠেলে ঠেলে ফেলে দেবে নিচে, অথবা পায়ের তলায় ফেলে ভেঙে দেবে ডিম, মেরে ফেলবে ছানাদের—এটাই প্রকৃতির নিয়ম, গোপন-গূঢ় রহস্যময়তা জড়িয়ে আছে এর সঙ্গে।
মূল বাসায় মূল মালিকের ডিম আগে ফুটবে বুঝলে কোকিল সেই বাসায় ডিম পাড়বে না সহজে—তাতে মূল ছানাদের সঙ্গে ঠেলাঠেলিতে পেরে ওঠা যাবে না সহজে। চাই কি, ওরাই ঠেলে-ঠুকরে একটা বেকায়দা অবস্থায় ফেলে দেবে।
কোকিল ভালো করেই জানে, তার ডিম কত দিনে ফুটবে। বংশরক্ষার অনিবার্য তাগিদেই একটি কোকিলা একাধিক বাসায় দু-একটা করে ডিম পাড়বে—কোনো না কোনো বাসার ছানা টিকে যাবে। ডিম পাড়ার পূর্ণ প্রস্তুতি শেষ, ঠিক সেই মুহূর্তে বাসার মালিক এলে কোকিলেরা দেয় উড়াল—ডিমটা ছেড়ে দিতে হয় শূন্যে, ডিম মাটিতে পড়ে ভেঙে যায়, এ রকম দৃশ্যও দেখেছেন অনেকে। আমার বিবেচনায় কোকিলেরা ডিম পাড়া বাসাগুলোতে নিয়মিত মনিটরিং-ব্যবস্থা চালু রাখে—ছানাদের ওড়া পর্যন্ত অধীর অপেক্ষা করে।
কোকিলেরা কী রকম চালাকি করে অন্য পাখিদের, বিশেষ করে কাকের মতো ধূর্ত পাখির বাসায় ডিম পাড়ে, তা অনেকেই জানেন। একদিন ‘কোকিলছানা’ বুঝতে পেরে কী রকম বোকা হয়ে যায় পালক মা-বাবারা! না না, বোকামি এটা নয়, প্রকৃতিরই অনিবার্য নিয়ম এটা, প্রকৃতিরই রহস্য।
পুরুষ কোকিল কালো। মেয়ে কোকিল অসংখ্য ছিট ছিট যুক্ত পাখি। পুরুষ কোকিলের কুহু কুহু তানে মানুষের মন কেমন-কেমন যেন করে ভরা বসন্তকালে। এরা আছে ঢাকা শহরসহ সারা দেশেই। ফুর্তিবাজ পাখি। ভালো আছে ওরা আমাদের দেশে। খাদ্য-সংকট বা থাকার সংকট নেই। শিকারিদের টার্গেটও নয় ওরা।