
মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা কেবল নিজে দূষণ করে না; বরং অন্যান্য ক্ষতিকর রাসায়নিক ও বিষাক্ত পদার্থ শোষণ করে বহন করতে পারে।
মাছ, কাঁকড়া, শামুক—সবাই এই কণাগুলো খেয়ে ফেলে এবং খাদ্যশৃঙ্খলের মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত মানুষের দেহেও পৌঁছে যায়।
কর্ণফুলী নদীকে বলা হয় চট্টগ্রামের প্রাণ; কিন্তু অব্যাহত দখল ও দূষণ নদীটিকে মুমূর্ষু করে তুলেছে। পয়ো ও গৃহস্থালির অপরিশোধিত বর্জ্য প্রতিদিন নদীতে গিয়ে পড়ছে। এতে হুমকির মুখে পড়ছে প্রাণবৈচিত্র্য। এখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা নদীর পানি ও পলিতে ‘মাইক্রোপ্লাস্টিক’ কণা খুঁজে পেয়েছেন। সম্প্রতি এ–সম্পর্কিত গবেষণাপ্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রতিদিন গড়ে পাঁচ হাজার মেট্রিক টনের বেশি বর্জ্য এই নদীতে গিয়ে মেশে। এর মধ্যে শিল্পকারখানা, পর্যটন, আবাসিক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বর্জ্যও রয়েছে। এসব বর্জ্যের সঙ্গে নদীর পানি ও পলিতে গিয়ে মিশছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। মাইক্রোপ্লাস্টিক বলতে, পাঁচ মিলিমিটারের চেয়ে ছোট প্লাস্টিক কণাকে বোঝায়। এ কণা কেবল নিজে দূষণ করে না; বরং অন্যান্য ক্ষতিকর রাসায়নিক ও বিষাক্ত পদার্থ শোষণ করে বহন করতে পারে। মাছ, কাঁকড়া, শামুক—এরা এই কণাগুলো খেয়ে ফেলে এবং খাদ্যশৃঙ্খলের মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত মানুষের দেহেও পৌঁছে যায়। এতে স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত ঝুঁকি বাড়ছে।
গবেষণাটির নেতৃত্ব দিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. শফীকুল ইসলাম। এই দলে আরও ছিলেন ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মো. ইকবাল সরোয়ার, মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক মুমতাহীনাহ্ জুঁই প্রমুখ। গবেষণার জন্য তিন ভাগে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে বর্ষা মৌসুম, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে শীত মৌসুম ও মার্চে গ্রীষ্ম মৌসুমে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। নদীর ২৪টি এলাকা থেকে নমুনা হিসেবে পানি ও পলি নিয়েছেন গবেষকেরা। পরে গবেষণাগারে উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে এসব নমুনা বিশ্লেষণ করা হয়। চলতি বছরের এপ্রিলে আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থা এলসেভিয়ারের মেরিন পলিউশন বুলেটিন জার্নালে গবেষণাপ্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে। গবেষকেরা বলছেন, কর্ণফুলীর মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ অত্যন্ত গুরুতর। এই প্লাস্টিক কণা সমুদ্রেও ছড়িয়ে পড়ছে। এতে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যও হুমকিতে রয়েছে।
গত মঙ্গলবার দুপুরে কর্ণফুলী নদীর শহরের অংশ ঘুরে দূষণের চিত্র দেখা গেছে। পানিতে ভাসছিল পলিথিন, প্লাস্টিকের বোতল, বোতলের মুখ, কর্কশিট, ছেঁড়া স্যান্ডেল, জালের টুকরাসহ নানা ধরনের বর্জ্য। সদরঘাট এলাকায় নদীর পানি ছিল কালো, নোংরা।
মাছ, কাঁকড়া, শামুক—এরা এই কণাগুলো খেয়ে ফেলে এবং খাদ্যশৃঙ্খলের মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত মানুষের দেহেও পৌঁছে যায়। এতে স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত ঝুঁকি বাড়ছে।
দূষণে মরণদশা
গবেষণায় দেখা গেছে, নদীর পৃষ্ঠজলে প্রতি ঘনমিটারে ১৪ দশমিক ২৩ থেকে ২৬ দশমিক ৬৮টি মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা এবং তলানির প্রতি কেজি পলিতে ৭৫ দশমিক ৬৩ থেকে ২৭২ দশমিক ৪৫টি কণা পাওয়া গেছে। শীতকালে সংগ্রহ করা নমুনায় ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণার মাত্রা সবচেয়ে বেশি। আর নিম্নপ্রবাহ এলাকায় দূষণ সবচেয়ে বেশি বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে শূন্য দশমিক ৩ থেকে শূন্য দশমিক ৫ মিলিমিটার আকারের কণা। রঙের দিক থেকে কালো ও নীল এগিয়ে। মাইক্রোপ্লাস্টিকের কারণে মাছের শারীরবৃত্তীয় ক্ষতি হয়। এই ক্ষুদ্র কণা হজমে বাধা দেয়। প্রজনন ও রোগ প্রতিরোধক্ষমতা ব্যাহত করে। পোনা মাছের বেঁচে থাকার হার কমাতে পারে।
কর্ণফুলীর মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ অত্যন্ত গুরুতর। এই প্লাস্টিক কণা সমুদ্রেও ছড়িয়ে পড়ছে। এতে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যও হুমকিতে রয়েছে।
গবেষক দল নদীতে ছয় আকারের মাইক্রোপ্লাস্টিক খুঁজে পেয়েছে। এর মধ্যে তন্তু আকারের মাইক্রোপ্লাস্টিকের পরিমাণ বেশি। পানিতে তন্তুর পরিমাণ ৪৫ দশমিক ২৪ শতাংশ ও পলিতে তন্তুর পরিমাণ ৫৭ দশমিক ৪৯ শতাংশ। পোশাক কারখানার বর্জ্য, মাছ ধরার পরিত্যক্ত জাল ও দড়ি থেকে তন্তুগুলো উৎপন্ন হয়।
চট্টগ্রাম শহরের উচ্চ জনঘনত্ব ও নদীর উভয় পাড়ে অবস্থিত অসংখ্য ছোট-বড় শিল্পকারখানা এই দূষণের সম্ভাব্য কারণ হিসেবে গবেষকেরা চিহ্নিত করেছেন। প্রবন্ধে বলা হয়, অপর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও প্লাস্টিক বর্জ্য নদীতে ফেলার প্রবণতা পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করেছে। ২০০২ সালে বাংলাদেশে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করা হলেও এর সঠিক বাস্তবায়ন হয়নি, যা দূষণ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
গবেষক দলের প্রধান অধ্যাপক শফীকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পরিস্থিতি মোকাবিলায় নদীতে ইচ্ছেমতো বর্জ্য ফেলা ঠেকাতে হবে। বর্জ্য থেকে শক্তি উৎপাদনকারী প্ল্যান্ট নির্মাণের উদ্যোগ নিতে হবে। একবার ব্যবহার করা যায়, এমন প্লাস্টিকের ব্যবহার বাড়াতে হবে। নয়তো পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে।
অন্যদিকে কর্ণফুলী হলো চট্টগ্রামে পানযোগ্য পানির প্রধান উৎস। প্রতিদিন প্রায় ২৮ কোটি লিটার পানি আসে এই নদী থেকে। ওয়াসা পরিশোধনাগারে বিভিন্ন রাসায়নিক মিশিয়ে পানি পানযোগ্য করে তোলে। গবেষক অধ্যাপক শফীকুল ইসলাম বলেন, এই পানি পুরোপুরি মাইক্রোপ্লাস্টিকমুক্ত কি না, তা নিয়ে ওয়াসা কর্তৃপক্ষকে কাজ করতে হবে। তবে ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলমের দাবি, তাঁদের সরবরাহ করা পানিতে মাইক্রোপ্লাস্টিক কিংবা অন্য কোনো পদার্থ থাকার সুযোগ নেই।
কর্ণফুলীর দুই পাশে ক্ষমতাধর ব্যক্তি ও কিছু দুষ্ট চক্র অবৈধভাবে দখল করে রেখেছে। জেলা প্রশাসন ও বিগত সরকারগুলোর গাফিলতি ও সদিচ্ছার অভাবে অবৈধ স্থাপনাগুলো উচ্ছেদ করা হয়নি। ফলে নদী বাঁচাতে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। জেলা প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও নাগরিকেরা মিলে এ নদীকে বাঁচাতে হবে।চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য মুহাম্মদ মোজাম্মেল হক
নদীর জায়গা দখল
বিভিন্ন গবেষণা ও জরিপে বলা হয়েছে, অব্যাহত দখল ও দূষণে এই নদীর প্রাণ যায় যায় অবস্থা। চট্টগ্রাম নগরের ব্রিজঘাট এলাকায় ১৯৯০ সালে নদীর প্রস্থ ছিল প্রায় ৯০০ মিটার। এই ঘাটের কাছাকাছি চাক্তাই এলাকায় ২০০৬ সালে শুরু হয় শাহ আমানত তৃতীয় সেতুর নির্মাণকাজ। ৯৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের সেতুটির আশপাশে জেগে ওঠা চর দখল করে বস্তি, পাকা অবকাঠামোসহ নানা স্থাপনা গড়ে ওঠে। এরও ছয় বছর আগে নদীর জায়গা ইজারা দেওয়া হয় মৎস্য অবতরণকেন্দ্র তৈরির জন্য। ফলে সেতু এলাকায় নদীর প্রস্থ কমে হয়েছে প্রায় ৫১০ মিটার। এভাবে নদীর বিভিন্ন অংশে অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে।
পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ ২০১০ সালে হাইকোর্টে নদী রক্ষায় একটি রিট করেছিলেন। এরপর ২০১৬ সালে হাইকোর্ট কর্ণফুলীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশ দেন। তখন স্থাপনা ছিল ২ হাজার ১১২টি। এরপর ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে নদীর সদরঘাট থেকে বারিক বিল্ডিং পর্যন্ত উচ্ছেদ কার্যক্রম চালিয়েছিল জেলা প্রশাসন। বারিক বিল্ডিং থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত উচ্ছেদ চালানোর দায়িত্ব ছিল বন্দর কর্তৃপক্ষের। দুই পক্ষ মিলে হাজারখানেক স্থাপনা উচ্ছেদ করে। এরপর অভিযান থেমে যায়।
সেতু এলাকায় নদীর প্রস্থ কমে হয়েছে প্রায় ৫১০ মিটার। এভাবে নদীর বিভিন্ন অংশে অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে।
চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের হিসাবে, বর্তমানে নদীর উত্তর পাড়ে প্রায় ২ হাজার অবৈধ স্থাপনা রয়েছে। দক্ষিণ পাড়ে অবৈধ স্থাপনার সংখ্যা পাঁচ শতাধিক। নদীর বিভিন্ন অংশ অবৈধভাবে দখল করে রেখেছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা।
কর্ণফুলী নদী প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য মুহাম্মদ মোজাম্মেল হক। তিনি চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, কর্ণফুলীর দুই পাশে ক্ষমতাধর ব্যক্তি ও কিছু দুষ্ট চক্র অবৈধভাবে দখল করে রেখেছে। জেলা প্রশাসন ও বিগত সরকারগুলোর গাফিলতি ও সদিচ্ছার অভাবে অবৈধ স্থাপনাগুলো উচ্ছেদ করা হয়নি। ফলে নদী বাঁচাতে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। জেলা প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও নাগরিকেরা মিলে এ নদীকে বাঁচাতে হবে।