
কোটি কোটি মানুষের রাজধানী ঢাকায় প্রকৃতি তার স্বকীয়তা হারিয়েছে অনেক আগেই। দম ফেলার মতো একখণ্ড ফাঁকা জায়গারও বড্ড অভাব। যেদিকে তাকাই, গায়ে গা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দালান। জঞ্জালে ভরা এমন একটি শহরে আবার বুনো উদ্ভিদ!
না, মোটেও ভাবনার বিলাসিতা নয়। আজ এমন তিনটি উদ্ভিদের কথা বলব, যেগুলো আমাদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে এই শহরে এখনো দিব্যি টিকে আছে। বুনো হিসেবে গাছগুলোর সন্ধান পাওয়া অনেকটা আবিষ্কারের মতোই।
১৮ থেকে ২০ বছর আগে পট্পটি দেখেছিলাম হাওরাঞ্চলে। অন্যান্য জেলায়ও বিক্ষিপ্তভাবে পথের দুপাশে এ ফুলের বন দেখেছি। কিন্তু তাই বলে ঢাকায় প্রাকৃতিকভাবে পট্পটি দেখতে পাব, এমনটা আশাই করিনি কখনো। যেখানে রীতিমতো পরিচর্যা করেও গাছপালা টিকিয়ে রাখা যায় না, সেখানে কিনা বুনো পট্পটির ফুল!
এক যুগ আগে রমনা পার্কের রেস্টুরেন্ট লাগোয়া লেকের পাড়ে ফুল দেখে অবাক হয়েছিলাম। পরে পট্পটির দ্বিতীয় আস্তানা খুঁজে পেলাম বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে। বর্ধমান হাউসের চারপাশে—পুকুরপাড়ে গ্রীষ্ম-বর্ষায় রীতিমতো এ ফুলের মেলা বসে। এগুলোর প্রাণশক্তিও অফুরান। মালিরা কয়েক দিন পরপর ঘাসের সঙ্গে কেটে ফেলেন বড় গাছগুলো। কিন্তু ছোট গাছগুলো দিব্যি বড় হয়ে আবার পুষ্পপ্রাচুর্যে ভরিয়ে রাখে চারপাশ। ভাবতে অবাক লাগে, এই ফুলের জন্মস্থান আবার সুদূর পেরু, গায়ানা ও কলম্বিয়া!
ষোড়শ শতকের দিকে ওলন্দাজদের বাণিজ্যিক জাহাজে আলুর বস্তা আর মাটির সঙ্গে মিশে পট্পটির বীজ ভারত উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ফুল বেশ রংবাহারি হওয়ায় তখনকার দিনে মোগল সম্রাটদের বাগানেও দিব্যি ঢুকে পড়েছিল। মাটির ক্ষয়রোধে এই গাছের পাতা ও শিকড়ের গাঁথুনি অত্যন্ত কার্যকর। স্থানীয়ভাবে এগুলো ‘চটপটি’ নামেও পরিচিত।
পট্পটির বৈজ্ঞানিক নাম Ruellia tubrosa বর্ষজীবী বা বহুবর্ষজীবী খাড়া বীরুৎ, ২০ থেকে ৬০ সেন্টিমিটার উঁচু হতে পারে। পাতা সরল, ৫ থেকে ৮ সেন্টিমিটার লম্বা, দীর্ঘায়ত ও চকচকে। মঞ্জরিদণ্ড দেড় থেকে তিন সেন্টিমিটার লম্বা, সরু ও এক থেকে তিন ফুলবিশিষ্ট। ফুলের রং বেগুনি। শিকড় মূত্রনালির পাথর অপসারণে কার্যকর, পাতার রস কণ্ঠনালির রোগে ব্যবহার্য।
ঢাকায় সংখ্যাধিক্যে বেশি এমন আরেকটি বুনো উদ্ভিদ পিপুলটি বা চাপাইত্তা। ঢাকায় এই গাছ অজস্র। পথের ধারে, পার্কে, পতিত জায়গায়, কোথায় নেই। স্থানীয়ভাবে গাছটি মেন্দা, কুকুরচিতা, রাতুন গারুর, কারজিউকি ইত্যাদি নামেও পরিচিত। একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, গ্রীষ্ম-বর্ষায় ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে থাকা হলুদ রঙের ছোট ছোট ফুলভর্তি ঝোপাল কিছু গাছ। দেখে মনে হতে পারে, কেউ হয়তো যত্ন করে লাগিয়েছেন গাছগুলো।
আসলে এমন কিছুই নয়। বিভ্রান্ত হয়েছিলাম আমিও। অজস্র পাতার ঠাসবুনটের ভেতরে অসংখ্য ফুলের সমারোহে গাছটি বেশ রাজসিক হয়ে ওঠে তখন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই গাছটির সঠিক পরিচয় জানতে পারি। আবিষ্কার করি, এ তো সেই গাছ, গ্রামে যে গাছের পাতা চটকে আঠালো পানির শরবত খেয়েছিলাম। পেটের পীড়ায় পাতার এই সুগন্ধি নির্যাস একেবারে মোক্ষম দাওয়াই। ধানমন্ডি, তেজগাঁও, রমনা পার্ক, বোটানিক্যাল গার্ডেন, শেরেবাংলা নগরসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে দেখা যায়। সুযোগ পেলে এগুলো রীতিমতো বৃক্ষ হয়ে ওঠে।
পিপুলটির বৈজ্ঞানিক নাম Litsea glutinosa মাঝারি আকারের চিরসবুজ বৃক্ষ, ৫ থেকে ১৮ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। পাতা পর্যায়ক্রমিক। ফুল গুচ্ছাকার, হলুদাভ সাদা। ফল রসাল, গোলাকার, পাকলে কালো হয়। ফুল ও ফলের মৌসুম বৈশাখ থেকে মাঘ। কাঠ ভাস্কর্যের জন্য উত্তম। বীজের তেল বাত রোগে কাজে লাগে। পাতা ও ছাল উদরাময় ও আমাশয়ে কাজে লাগে। গাছের মূল বলবর্ধক, কাশি নিরাময় এবং প্রদাহ, গিঁটে ব্যথা, গলার সমস্যা, প্লীহার রোগ ও পক্ষাঘাতের চিকিৎসায় বেশ কার্যকর।
ঢাকার বুনো উদ্ভিদের মধ্যে বনজিগা বা জীবনও অন্যতম। এ ছাড়া গাছটি জিনাল, চিকন ও গোবরজিগা নামেও পরিচিত। ঢাকার বিভিন্ন পতিত স্থানে এখনো গাছটি সহজদৃষ্ট। তেজগাঁও শিল্প এলাকার পতিত বাড়িগুলোতে বেশ কিছু গাছ দেখা যায়। এ ছাড়া বিভিন্ন সরকারি আবাসিক এলাকায়ও অল্পবিস্তর চোখে পড়ে। এ গাছের ফল পাখির অত্যন্ত প্রিয়। পাকা ফল খেতে কবুতর, ঘুঘুসহ বিভিন্ন পাখি ভিড় করে। কবুতর ও ঘুঘু ফল খাওয়ায় গাছটির অন্য নাম ‘পিজিওন উড’ গাছ। অন্তত ১৪ প্রজাতির প্রজাপতি তাদের লার্ভা তৈরির খাদ্য হিসেবে এটিকে ব্যবহার করে। ছাগল, গরু, মহিষের খাবার হিসেবে এ গাছের পাতা, ডাল ও বীজ ব্যবহৃত হয়।
বনজিগার বৈজ্ঞানিক নাম Trema orientalis দ্রুত বর্ধনশীল মাঝারি আকারের ৮-১০ মিটার উঁচু চিরসবুজ গাছ। বাকল পাতলা, মসৃণ ও সবুজ-ধূসর রঙের। পাতা ডিম্বাকৃতির। ফুল ছোট, সবুজাভ। ফল ঝুলন্ত, গোলাকার। কাঠ নরম ও জ্বালানি উপযোগী, চা ও ম্যাচের বাক্স তৈরিতে কাজে লাগে। পাতা ও ছাল কফ, গলার ক্ষত, হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস, গনোরিয়া, জন্ডিসজনিত জ্বর, দাঁতব্যথা এবং সাধারণ বিষাক্ততার প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
ঢাকায়এমনআরওকিছুবুনোউদ্ভিদআছে।সেইগল্পআরেকদিনশোনাবআপনাদের।
মোকারম হোসেন, প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক