গত ১৮ মে সিঙ্গাপুর যাচ্ছিলাম। ইউসুফ এস আহমেদ লিখিত এবং ইশতিয়াক হাসান অনূদিত উইথ দ্য ওয়াইল্ড অ্যানিমেলস অব বেঙ্গল বইটি অবসরে পড়ার জন্য সঙ্গে নিলাম। ইউসুফ এস আহমেদ একসময় পাকিস্তানের ইন্সপেক্টর জেনারেল অব ফরেস্ট ছিলেন। ১৯২৬ সালে তিনি বন বিভাগে যোগ দেন এবং ১৯৫৯ সালে অবসরে যান। তাঁর ৩৩ বছরের অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ বইটির ৪১ পৃষ্ঠায় লিখিত বক্তব্যটি আমার নজর কাড়ে। ততক্ষণে বিমান সিঙ্গাপুরের মাটি ছুঁয়েছে, যে দেশটি তার শেষ বাঘটি হারিয়েছে ১৯৩০ সালে।
ইউসুফ এস আহমেদ ১৯২৯ সালে সুন্দরবন ডিভিশনের দায়িত্ব পান। বন্য প্রাণীর প্রতি আগ্রহের কারণে শিগগিরই ‘ওয়াইল্ড ম্যান অব ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট’ নামে পরিচিতি পেলেন। তিনি লিখেছেন, ‘ভোলা নদীর ওপারে ধানসাগর গ্রাম সুন্দরবনের এই অংশে পুবের সীমানা হিসেবে কাজ করছে। ১৯২৯/১৯৩০ সালের শীতকাল। বাঘের চামড়া এবং মাথাসহ পুরস্কার দাবি করে একটি চিঠি এল স্থানীয় পুলিশ ক্যাম্প থেকে।’
বাঘটি ধানসাগর গ্রামে ঢুকে পড়লে স্থানীয় শিকারিদের সহায়তায় পুলিশের একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব ইন্সপেক্টরের গুলিতে মারা পড়ে। ধানসাগর শরণখোলা উপজেলার অধীন বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের অন্তর্গত। এটি প্রায় ১০০ বছর আগের ঘটনা।
শত বছর পর ইদানীং বাঘ-মানুষ দ্বন্দ্ব একটি পর্যায়ে এসেছে। বাংলাদেশ বন বিভাগের সহযোগিতায় ওয়াইল্ডটিম নামক সংগঠনটি সুন্দরবনের চারপাশে ‘ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিম’ গঠন করেছে। সুন্দরবনের প্রায় ৮০ শতাংশ গ্রামে এখন ৩৪০ জন স্বেচ্ছাসেবক ৪৯টি দলে ভাগ হয়ে প্রায় ১৮ বছর ধরে বাঘ-মানুষ দ্বন্দ্ব নিরসনে কাজ করে যাচ্ছেন। কোনো বাঘ গ্রামে ঢুকলেই এই দলের সদস্যরা বন বিভাগের সহযোগিতায় বাঘটিকে বনে ফিরিয়ে দেন।
দেশের কোথাও বন্য প্রাণী, বিশেষ করে বাঘ মারলে একসময় এলাকায় তিনি ‘হিরো’ হয়ে যেতেন। এটি ছিল সামাজিক স্বীকৃতি। কিন্তু ব্রিটিশরা ভাবলেন, সুন্দরবনের যেসব এলাকা থেকে রাজস্ব বেশি আয় হয়, সেখানকার বনকর্মীদের পুরস্কৃত করলে ওই সব এলাকা বাঘশূন্য করা যাবে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক রঞ্জন চক্রবর্তী লিখেছেন, ১৬ নভেম্বর ১৮৮৩ সালে সরকার ‘ক্যালকাটা গেজেট’–এর মাধ্যমে ঘোষণা করলেন: একটি পূর্ণবয়স্ক বাঘ মারলে ৫০ রুপি এবং বাচ্চা মারলে ১০ রুপি পাওয়া যাবে। অবশ্য চামড়া ও মাথার খুলি জমা দিতে হবে। ১৯০৬ সালে এটি বাড়িয়ে ১০০ রুপি এবং ১৯০৯ সালে ২০০ রুপি করা হলো। ১৮৮১ থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত ২ হাজার ৪০০টি প্রাপ্তবয়স্ক বাঘ মারা পড়েছে। যদিও এটি সরকারি হিসাব, বেসরকারি হিসাব কখনো জানা যায়নি। বাংলাদেশে একসময় প্রায় সর্বত্রই বাঘ ছিল, কিন্তু সুন্দরবনই আজ আমাদের ১২৫টি বাঘের শেষ আশ্রয়স্থল।
একদিন সিঙ্গাপুর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের লি কং চিয়ান প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘরে গেলাম। এখানে ‘স্পার্ম হোয়েল’ বা ‘শুক্রাণু তিমি’র একটি কঙ্কাল প্রদর্শিত হচ্ছে। এটি শুধুই একটি নমুনা নয়, এর পেছনের গল্পটি সিঙ্গাপুরবাসীর সংহতি ও জাতীয় ঐক্যের ইতিহাস। ২০১৫ সালে সিঙ্গাপুরের জলসীমায় তিমিটি মৃত অবস্থায় দেখা যায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে সংবাদটি দেশের সরকারি–বেসরকারি সব স্তরের জনগণের কাছে পৌঁছে যায় মুহূর্তেই। তাঁরা এটির টিস্যু সংগ্রহ করে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা শুরু করেন এবং জাদুঘরকে সহযোগিতা করেন এর কঙ্কাল সংরক্ষণ করে জাদুঘরে রাখতে।
২০১৫ সালে সিঙ্গাপুর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী, অর্থাৎ ৫০ বছর পালন উপলক্ষে এটিকে ‘জুবিলি হোয়েল’ হিসেবে চিহ্নিত করে। তিমিটির পেটে প্লাস্টিক দেখতে পেয়ে জাদুঘরের সংগ্রাহকেরা উদ্বিগ্ন হয়ে সৈকতে কোনো প্লাস্টিক দ্রব্য আছে কি না, খুঁজতে থাকেন এবং ১৪৩টি স্যান্ডেল ও জুতা, প্রায় ৯০০ ফুট দড়ি আর মাছ ধরার সরঞ্জাম, প্রায় ১ হাজারটি প্লাস্টিক বোতল সংগ্রহ করেন।
আমাদের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ ঘোষণার’ সঙ্গে সঙ্গে এটিও মনে করিয়ে দেন যে বাংলাদেশ পৃথিবীর প্রথম দেশ, যারা ২০০২ সালে পলিথিনের তৈরি ব্যাগ নিষিদ্ধ করেছে। তিনি সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছেন, এ জন্য ধন্যবাদার্হ।
মো. আনোয়ারুল ইসলাম, সাবেক অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়